ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

চোখ বুজে থাকলেই বুঝি শান্তি পান ওরে নীল দরিয়ার গায়ক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫৪ ঘণ্টা, জুন ৬, ২০১৭
চোখ বুজে থাকলেই বুঝি শান্তি পান ওরে নীল দরিয়ার গায়ক হাসপাতালের বেডে আব্দুল জব্বার পাশে লেখক

সোমবার (৫ জুন) রাত দশটা ছুঁই ছুঁই। উঁকি দিতেই দেখলাম জীর্ণশীর্ণ শরীরের একটা মানুষ শুয়ে আছেন। কাছে যেতে চোখ মেলে তাকালেন। পরিশ্রান্ত দেহ! কথা বলতে বলতে চোখ বুজে যায় তার। ইচ্ছা থাকলেও কথা বলতে পারছেন না। চোখ বুজে থাকলেই বুঝি শান্তি!

মানুষটি অপরিচিত কেউ নন। কিংবদন্তী শিল্পী আব্দুল জব্বার।

বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী। আব্দুল জব্বার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’সহ আরও অনেক কালজয়ী গানের গায়ক।

দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ তিনি।   হাসপাতালের কেবিনে শয্যাশায়ী। কিডনি, হার্ট, বাল্বসহ বহুমুখী রোগে আক্রান্ত। মাঝে মাঝে হাসপাতাল থেকে মন্ত্রী, সাংসদ কিংবা বিত্তবানদের কাছে ‍ছুটে যেতেন কিছু আর্থিক সহায়তার জন্য। কিছু সাহায্যের আশ্বাস নিয়ে আবার হাসপাতালে ফিরে যেতেন।

তেমনি একদিন ২৩মে দুপুরে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে একজন স্টাফ এসে জানাল, একজন শিল্পী মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে সাক্ষাত প্রত্যাশী। আমি বললাম, রুমে নিয়ে আসো।

তিনি এসে আমাকে বললেন, ‘আমি আব্দুল জব্বার’।

আমি বললাম, ‘আর পরিচয় দিতে হবে না, আপনাকে বাংলাদেশে এক নামে চিনে। বলুন আপনাকে কীভাবে সহযোগিতা করতে পারি?’

তিনি বললেন, ‘দাদু, আমার শরীর শেষ পর্যায়ে, আমাকে তাড়াতাড়ি চিকিৎসার ব্যবস্থা করো। আমি বেশি দিন বাঁচবো না। ’

আমি তাকে দ্রুত মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি স্যারের অফিস কক্ষে নিয়ে গেলাম। মন্ত্রী মহোদয় তাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন! এই মানুষ এখানে কেন? এই মানুষের এমন বেহাল দশা কেন? তার সব কথা শুনে মন্ত্রী তার চিকিৎসার জন্য সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।

এবার শিল্পীকে নিয়ে মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ও মন্ত্রীর একান্ত সচিব মু. মোহসিন চৌধুরীর অফিস কক্ষে বসলাম। মোহসিন স্যার বললেন, ‘জব্বার ভাই বাংলাদেশের সম্পদ। তাকে আমাদের সবার সহযোগিতা করা উচিত। নিরু তুমি উদ্যোগ নাও। আমরা সবাই একযোগে চেষ্টা করব’।

সেই রাতে জব্বার ভাইকে নিয়ে ফেসবুকে একটি লেখা দিলাম। লেখাটি নিয়ে চারিদিকে তুমুল হৈ চৈ পড়ে গেল। আমাদের মন্ত্রীর বড় ছেলে সানোয়ারা গ্রুপ অব কোম্পানিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমান বললেন কেউ পাশে থাকুক বা না থাকুক আমি শিল্পীর পাশে থাকবো। তিনি তখন দেশের বাইরে ছিলেন। দেশে এসে নগদ পাঁচ লাখ টাকা অনুদান দিলেন এই মহান শিল্পীকে।

মিডিয়ায় খবরটি ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হলো। সব দিকে জানাজানি হলো, জব্বার ভাই অসুস্থ। একে একে অনেকেই এগিয়ে আসলেন। ওয়ালটন গ্রুপ দিল পাঁচ লাখ টাকা, বাংলাদেশ রিক্রুটিং এজেন্সির সংগঠন বায়রা দিল দুই লাখ টাকা। ইতোপূর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবদুল জব্বারের চিকিৎসার জন্য ২০ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজে এসে শিল্পীর খোঁজখবর নিলেন।

জব্বার ভাইয়ের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তার পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা করতে ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার প্রয়োজন এবং তার বয়স বিবেচনায় দেশের বাইরে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

আপনারা জানেন কে এই জব্বার? আমরা কি ভুলতে বসেছি আমাদের সংস্কৃতির একজন পুরোধাকে, যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে গান গেয়ে বীর সৈনিকদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। কলকাতাসহ সারা ভারতের মোড়ে মোড়ে গণসংগীত গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ফান্ড সংগ্রহ করেছেন। সেই সময়ে নগদ ১২ লাখ টাকা তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ তহবিলে অকাতরে দান করেছেন। তখনকার ১২ লাখ টাকা কি এখন ৫০ কোটি টাকার সমপরিমাণ হবে না?

গেয়েছেন অসংখ্য কালজয়ী গান-‘তারা ভরা রাতে’, ‘ও...রে নীল দরিয়া’। তার গাওয়া ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান তিনটি ২০০৬ সালের মার্চ মাস জুড়ে বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের বিচারে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২০টি গানের তালিকায় স্থান লাভ করেছে। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত দুটি সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক (১৯৮০) ও স্বাধীনতা পুরস্কারে (১৯৯৬) ভূষিত হন।

এখন ২০১৭ সাল। বিজয়ের অনেক বছর পেরিয়েছে। দেশ অনেকদুর এগিয়েছে। কিন্তু অমর শিল্পী আব্দুল জব্বার সামান্য চিকিৎসার টাকার জন্য দুয়ারে দুয়ারে যাচ্ছেন। এই আমাদের দুর্ভাগ্য! আমরা আব্দুল জব্বারের কাছে লজ্জিত!

তিনি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন। শরীর আর চলে না। তবে বলেন, আমি এ দেশকে অনেক ভালোবাসি, তোমাদের ভালোবাসি।

মহান শিল্পীকে জিজ্ঞেস করলাম, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ ‍মুজিবুর রহমানের সাথে আপনার কোনো স্মৃতি মনে পড়ে কিনা?

তিনি বললেন, ‘১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসায় আমি একটা পতাকাবাহী গাড়ি নিয়ে যাই। তখন সিকিউরিটি গার্ড আমাকে আটকে দেয়। পরে বঙ্গবন্ধুর কাছে নালিশ গেলে বঙ্গবন্ধু বলেন, জব্বার হচ্ছে জয় বাংলার সৈনিক। সে পতাকা না লাগালে কে পতাকা লাগাবে? তিনি সিকিউরিটি গার্ডকে ধমকের সুরে তাড়িয়ে দেন। বঙ্গবন্ধু মাঝে মাঝে রাত দশটায় আমাকে গান শোনানোর জন্য ডেকে নিয়ে যেতেন। বঙ্গবন্ধু আমাকে বড়ই ভালোবাসতেন। ’

আমরা শিল্পীর পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা চাই। এ ব্যাপারে সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসবেন বলে আশা করি।

লেখক: তরুণ লেখক ও সংগঠক।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।