ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ন্যানোবিজ্ঞান

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৮ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০১৭
ন্যানোবিজ্ঞান ন্যানোবিজ্ঞান

সংক্ষিপ্তকরণের কৌশলের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ন্যানোবিজ্ঞান। অবশ্যই ছোট, কিন্তু কতটুকু ছোট- সেই পরিমাপের দিকটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেউ যদি ভেবে থাকেন, ট্রানজিস্টার ক্রমাগত ছোট হতে হতে অণু-পরমাণু পর্যায়ে পৌঁছে যাবে, আর ইনটেল কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার গর্ডন মুরের সূত্রানুযায়ী মাইক্রোচিপের কার্যকারিতাও বেড়েই চলবে, তবে সেটা মস্ত বড় ভুল হবে।

কারণ যে কোনো বস্তুর আয়তন একশ ন্যানোমিটারের নিচে নেমে গেলে সেগুলো চলে আসবে ন্যানোর জগতে এবং কোয়ান্টাম প্রভাবের আওতায়। যেমন ধরা যাক, একটি তার।

সেই তারের মধ্যদিয়ে বিদ্যুৎ পাঠিয়ে তার রোধ ও রোধাঙ্ক নির্ণয় করার নিয়ম ওহম্-এর সূত্রানুযায়ী বহুদিন আগে থেকেই জানা হয়ে গেছে। কিন্তু ক্ষুদ্রকরণের ধারায় সেই তারের ব্যাস যদি একশ ন্যানোর কম হয়, তাহলে এ সহজ-সরল ওহমের সূত্র আর খাটে না।

তখন সেই তারের মাধ্যমে তড়িৎ পরিবহন একটি জটিল পদ্ধতিতে পরিণত হয়। টানেলিংয়ের প্রভাবে তখন কুপরিবাহী দেওয়ালের মধ্যে দিয়েও কিছুটা তড়িৎ চলাচল করতে পারে। ট্রানজিস্টারের ক্ষেত্রে এর ফলটা হয় ধ্বংসাত্মক। নির্দিষ্ট ভোল্টেজের প্রভাবে সে ‘অন’ বা ‘অফ’ হবে কিনা, সেই মূল ব্যাপারটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এই জন্যই বলা যায় যে, বর্তমান প্রযুক্তিতে সবচেয়ে ছোট ট্রানজিস্টার এবং সবচেয়ে উন্নত মাইক্রোচিপের সীমা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা ট্রানজিস্টারের আয়তন মোটামুটি ১৩০ ন্যানো পর্যন্ত নামাতে সক্ষম হয়েছেন- যেটা ন্যানো মাত্রাকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে। এর পরে এই ‘ফ্যাব্রিকেশন’ পদ্ধতিরই আমূল পরিবর্তন দরকার, না হলে গর্ডন মুরের সূত্র আর খাটবে না।

ন্যানোমেটিরিয়াল বা ন্যানোটেকনোলজি- যাই বলা হোক না কেন, ন্যানোর এ ধারণাটি কিন্তু সর্বপ্রথম দিয়েছিলেন ‘বিচ্ছু বিজ্ঞানী’ নামে পরিচিত বিখ্যাত রিচার্ড ফাইনম্যান। ১৯৫৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর আমেরিকার ফিজিক্যাল সোসাইটির এক আলোচনা সন্ধ্যায় তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তার শিরোনাম ছিল ‘দেয়ার ইজ প্লেন্টি অব রুম অ্যাট দ্য বটম’। সবাইকে অবাক করে এই বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন এমন এক নতুন বস্তু জগতের কথা- যা আমাদের মধ্যে থেকেও আসলে আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। যে জগতের বস্তুপুঞ্জ সাধারণ নিয়মে নয়, কোয়ান্টাম সূত্র মেনে চলে।

যে সময়ে এ সব কথা বলা হয়েছিল, তখন কম্পিউটার ছিল এক অতিকায় বস্তু-বিশেষ। সেই রকমের একটি পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানী ফাইনম্যান বলেছিলেন, অণু-পরমাণু দরকার মতো সাজিয়ে ঠিক মাপমতো কিছু তৈরির কথা। বলেছিলেন, একটি বালির কণার মাপের তথ্যভাণ্ডারের কথা- জীবকোষকে ‘মডেল’ হিসেবে ধরে ছোট্ট অথচ বিচিত্র কার্যকারিতার মেশিন তৈরির কথাও। তখনকার দিনে এ ধারণা এতোটাই আশ্চর্যজনক ছিল যে, উপস্থিত বিজ্ঞানীরা অনেকেই এটাকে ‘বিচ্ছু ফাইনম্যানের স্বভাবসিদ্ধ প্র্যাকটিক্যাল জোক’ বলে ভেবেছিলেন।

তবে সত্যি কথা বলতে কি, ওই ‘প্লেন্টি অব রুম’ যে ঠিক কতটুকু নীচে, মানে ‘মিনিয়েচারাইজেশন’ বা ‘ক্ষুদ্রায়ণ’-এর সেই সময়কার অবস্থাটা আসলে কেমন- সে সম্পর্কে বিজ্ঞানী ফাইনম্যানেরও নিজের দিক থেকে কোনো ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ- এমন কি সঠিক কোনো ধারণাও ছিল না। তাই তিনি সেই বক্তৃতার সময় বিদ্যমান দুটি চ্যালেঞ্জের কথা বলে উক্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাকারীর জন্য তৎকালীন এক হাজার ডলার করে পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন! অবশ্য একটি চ্যালেঞ্জ মাত্র এক বছরের মধ্যে (১৯৬০ সালে) নিরসন করা সম্ভব হয়েছিল। সেটি হচ্ছে, একটা ০.৪ মিলিমিটার ঘনকের মাপের বিদ্যুৎচালিত মোটর তৈরি করতে পারার প্রসঙ্গ। অন্যটা ছিল বইয়ের পাতার আয়তন পঁচিশ হাজার ভাগ কমানো। সেটা পেরে উঠতে অবশ্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত।

বিচ্ছু বিজ্ঞানী ফাইনম্যান আলোচনার সূত্রপাত করে বিজ্ঞান-চিন্তকদের উসকে দিলেও ন্যানো- এই বিশেষ শব্দটির ব্যবহার তো দূরে থাকুক, উল্লেখও করেননি। ১৯৭৪ সালে জাপানের টোকিও সায়েন্স ইউনির্ভাসিটির বিজ্ঞানী নোরিও আনিগুচি সর্বপ্রথম ‘ন্যানোপ্রযুক্তি’ নামটি ব্যবহার করেন এবং ন্যানো সম্পর্কে একটি পরিষ্কার সংজ্ঞাও দেন। তবে এই প্রাথমিক ধারণাকে পরিপুষ্ট করে একটি বিজ্ঞানসম্মত-বিশ্বাসযোগ্য স্তরে পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব বিজ্ঞানী এরিক ড্রেক্সলারের।

ন্যানোবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রকৃত রূপটি তুলে ধরা এবং এর ব্যবহারিক-প্রায়োগিক উপযোগিতার দিকটি স্পষ্টভাবে তুলে ধরাই ড্রেক্সলারের প্রধান সাফল্য। তিনিই সমমনাদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘ফোরসাইট ইনস্টিটিউট’-যার কাজই হলো ন্যানোপ্রযুক্তি সংক্রান্ত নানা বিষয় আর তত্ত্ব ও ধারণাগত দিক নিয়ে নিরন্তর গবেষণা ও চর্চা করা। ফাইনম্যানের চ্যালেঞ্জ শেষ হওয়ার পর ফোরসাইট বার্ষিক পুরস্কার চালু করে ন্যানোচর্চাকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে। ড্রেক্সলারের লেখা ‘ইঞ্জিনস অব ক্রিয়েশন: দ্য কামিং এরা অব ন্যানোটেকনোলজি’ হলো ন্যানো প্রসঙ্গে প্রকাশিত প্রথম বই, প্রকাশ কাল ১৯৮৬। এছাড়াও ড্রেক্সলার আরেকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বই লিখেছিলেন ১৯৯২ সালে, নাম ‘ন্যানোসিস্টেমস: মলিকিউলার মেশিনারি, ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড কম্পিউটেশন’। বলতে গেলে এরপর থেকেই ন্যানো,  ন্যানোবিজ্ঞান, ন্যানোটেকনোলজি একটি সত্যিকারের একাডেমিক রূপ পরিগ্রহ করে।

সাধারণত কোনো জিনিস দু’ভাবে তৈরি হতে পারে। বড় একটি জিনিসকে কেটে-ছেঁটে মাপমতো আনা যায়Ñ যেভাবে এককালে মানুষ একটি বড় গাছের ডাল বা পাথরের চাঁই কেটে অস্ত্রশস্ত্র বানাতো বা এখন মানুষ যেভাবে জামাকাপড় বানায় থান থেকে কেটে। অথবা একেবারে প্রাথমিক স্তরের জিনিস পর পর ইচ্ছেমতো সাজিয়েও গড়ে তোলা যায় দরকার মতো বস্তুর অবয়ব।

যেমন ইটের পর ইট সাজিয়ে বাড়ি কিংবা সুতার পর সুতা বুনে কাপড়। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই দুই পদ্ধতির নাম যথাক্রমে ‘টপ ডাউন’ আর ‘বটম আপ’ পদ্ধতি। ‘বটম আপ’ কৌশল স্বভাবতই ‘টপ ডাউন’-এর তুলনায় অনেক বেশি সুবিধাজনক: উপকরণের বাজে খরচ নেই, উৎপাদনে শক্তির অপচয় নেই, ইত্যাদি। কিন্তু বস্তুটি যেখানে ন্যানোমিটার মাপের, সেখানে ‘বটম আপ’ মানে হল একেবারে অনু-পরমাণু পর্যায় থেকে বানানো শুরু করা।

সঠিকভাবে বললে এইটাই হলো ন্যানোটেকনোলজির আসল অনুপ্রেরণা। ফাইনম্যানও তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমি যতটা বুঝি, তাতে মনে হয় পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলো কিন্তু পরমাণুর পর পরমাণু সাজিয়ে কিছু গড়ে তোলার ধারণার বিরোধিতা করে না। এর জন্য কোনো নিয়মকানুন ভাঙার দরকার পড়ে না। অন্তত তাত্ত্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে যে এটা সম্ভব। তবে এখনও সেটা করে ওঠা যায়নি তার কারণ আমরা নিজেরাই অতিকায়। ’ আসলে ‘বটম আপ’ পদ্ধতিতে ন্যানোজগতে ঢোকার অসুবিধা ওটাই। মানুষের কাজকর্ম সবই হলো কোটি কোটি পরমাণু নিয়ে। আমাদের যন্ত্রপাতিও ওই রকম কোটি কোটি পরমাণু দিয়ে তৈরি জিনিসের সমষ্টি। ফলে একটি বস্তুর দৃশ্যত ব্যবহার অদৃশ্যে কোটি কোটি পরমাণুর কারবার। তাই দশ-বিশটা কি বড়জোর একশ-দুইশ পরমাণুকে আলাদা করে নিয়ে কাজ করা, হাতে ধরে ধরে জায়গা মতো বসানো, তারপর ঠিক মতো হলো কিনা সেটা দেখা, এসব এমনিতেই মানুষের অসাধ্য কাজ।

এরপর সেই জিনিসগুলো নিয়ে আবার অন্য কাজ করা, তাদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করা, এ তো বহু দূরের অসাধ্য ব্যাপার। তাই মানুষের ‘বড়দের জগতে’ ছোট ছোট জিনিস সাজিয়ে বড় কিছু বানানো যত সহজ ও সুবিধাজনক, ন্যানোজগতে ততটাই কঠিন এবং প্রায় অসাধ্য।

অথচ প্রকৃতি এই সূক্ষ্ম কাজ করতে পেরেছে অনায়াসে। ন্যানো বস্তুর যে অদৃশ্য জগৎ, খুব শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রেও যার ধরাছোঁয়া পাওয়া যায় না, তারও জমজমাট সম্ভার কিন্তু প্রকৃতিতেই সাজানো রয়েছে। বিজ্ঞানী ফাইনম্যান তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, জীবজগতের নানারকম ঘটনাই তাকে অনুপ্রাণিত করছে। রাসায়নিক শক্তি কীভাবে বিভিন্নরূপে ব্যবহৃত হয়ে যাবতীয় বিচিত্র ঘটনাবলী ঘটিয়ে চলেছে, তা ভেবে তিনি চমৎকৃত হয়েছেন। পরবর্তীকালে ড্রেক্সলার, যিনি নিজেও একজন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার, তিনিও এই ধারণাকেই আশ্রয় করেছেন যে, প্রকৃতিই ন্যানোবিজ্ঞানের যাবতীয় উদ্ভাবনের মূল প্রেরণা। সরাসরি একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। এই যে বক্ষ্যমান লেখাটি আপনি পড়ছেন, এর মধ্যেই হাজার হাজার ন্যানোমেশিন আপনার শরীরে কাজ করছে। মানুষের প্রত্যেকটি কোষই তো একাধারে এক একটি কারখানা এবং তথ্যপ্রযুক্তির কেন্দ্র।

এদিকে তার ভেতরে অজস্র মেশিন, বাইরে থেকে কাঁচামাল আসছে, শক্তি উৎপাদন হচ্ছে, তা অজস্র রকম কাজে ব্যবহার হচ্ছে, উদ্বৃত্ত জমা হচ্ছে সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোষের এক অংশের মধ্যে। এক একটা কারখানায় এক এক রকমের কাজ; পেশির কোষ শক্তি সরবরাহ করছে, স্নায়ুকোষ খবর আদানপ্রদান করছে বিদ্যুৎগতিতে, লোহিত রক্তকণিকা বাতাসের অক্সিজেনকে শরীরে ঢুকিয়ে নিচ্ছে, চৌম্বকবোধসম্পন্ন জীবাণু জ্যান্ত কম্পাসের মতো উত্তরদিক চিনে নিচ্ছে, সবুজ পাতার কোষ শর্করা তৈরি করছে, আর এ সব কিছুই হচ্ছে শত শত প্রোটিন অণুর তৎপরতায়। তাই সেগুলো নিজেরাই এক একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত মেশিন। এই সব মেশিন যে শুধু শরীরের ভেতরেই কাজ করে তা-ও নয়, বিভিন্ন উৎসেচক (এনজাইম), প্রোটিন, হরমোন ইত্যাদি শরীরের বাইরে এসেও চমৎকার কাজ করে। আর নিউক্লিয়াসের মধ্যে সরু সুতোর মতো ওই যে ডিএনএ, যার এক-একটা ছোট অংশের নাম জিন, যে আসলে শরীরের তথ্যভাণ্ডার, তার থেকে কম জায়গায় আর বেশি তথ্য কোনো কম্পিউটার রাখতে পেরেছে আজ পর্যন্ত ? আর শুধু তথ্য সংরক্ষণই নয়, মেশিন ল্যাঙ্গুয়েজ, কম্পাইলার, ডি-কোডার, সব সেখানে মজুদ আছে আর নিখুঁতভাবে কাজও করছে। জীববিদ্যার দৌলতে এই সবই আমাদের জানা কথা। কিন্তু এই যে আপনি হাত তুলে বইয়ের পাতাটা উল্টালেন, আর তার মধ্যে লাখ লাখ ন্যানোমেশিন নির্ভুল ছন্দে কাজ করে গেল, এই উপলব্ধি আমাদের পুরনো জানাকে নতুন একটি রূপ দিল। অর্থাৎ বোঝা গেলো যে শক্তি-বুদ্ধি-অনুভূতি এই সবকিছু মিলিয়েই বিশ্বের সবচেয়ে জটিল আর উন্নত যে যন্ত্রের নাম মানুষ, তার নিয়ন্ত্রণ কিন্তু ন্যানোমেশিন আর ন্যানোমেটিরিয়ালের হাতে, যারা অনেকেই আসলে এক-একটি বড়সড় অনু মাত্র।

বাংলাদেশ সময়: ০০৫৬ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।