ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

ভারতীয় সংসদে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩২৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১৭
ভারতীয় সংসদে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ স্বাধীনতার রক্তকথন

২৬ মার্চ ১৯৭১। দিল্লি। দুপুর ২টা ৪ মিনিটি। ভারতের লোকসভা। স্পিকারের আসনে বসলেন শ্রী আর ডি ভাণ্ডারি। আলোচনার বিষয় পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী।

গত রাতেই ঢাকায় পরিচালিত হলো ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর এক নিদারুণ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও তার আঁচ লেগেছে। তাই সেদেশের সংসদ বা লোকসভার সদস্যরা সমস্বরে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে থাকেন।
 
আলোচনার শুরুতেই লোকসভার সদস্য শ্রী সমর গুহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃসংশতা, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। তিনি বাংলাদেশের ঘটনাবলীর বিস্তারিত বর্ণনাও করেন।
 
শ্রী গুহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের হাজার হাজার মানুষকে হত্যার প্রতিবাদ করেন। তিনি অবিলম্বে বিষয়টি জাতিসংঘে তথা বিশ্বদরবারে তুলে ধরার আহ্বান জানান।
 
শ্রী গুহ বলেন, ‘পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে জানিয়ে দেওয়া দরকার যে ইয়াহিয়া খান যে ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন করেছেন তার বিরুদ্ধে সমগ্র ভারতবাসী শেখ মুজিবের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে’। শুধু  শ্রী গুহই নয়, লোকসভার বাকি সদস্যরাও পাকিস্তান সরকারের এ ভূমিকার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তারা সবাই এর বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন।  
 
লোকসভার আরেক সদস্য ইসহাক সম্ভলীও পাকিস্তান সৈন্যদের হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ করেন ও বিষয়টি জাতিসংঘে গুরুত্বে সঙ্গে তোলার আহ্বান জানান। তিনি অনতিবিলম্বে এ হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার আহ্বান জানান।
 
লোকসভার মতো রাজ্যসভায়ও বাংলাদেশের ঘটনাবলী নিয়ে বিস্তারিত  আলোচনা হয়। ২৭ মার্চ রাজ্যসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী সর্দার শরণ সিংহ বলেন, পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পদদলিত করে আলোকিত পথ থেকে অন্ধকারের পথে, ট্র্যাজেডির পথে, বিপর্যয়ের পথে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে ঠেলে দিয়েছে। তিনি পাকিস্তান সরকার ও সামরিক বাহিনীর এ ধরনের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করেন ও অবিলম্বে তাদেরকে এ পথ থেকে সরে আসতে বলেন।  
 
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর অনবদ্য ভূমিকা জাতি চিরদিন স্মরণ রাখবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তিনি অন্যতম এক অভিভাবক। প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে ভারত আশ্রয় দেওয়া থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের পক্ষে জনমত গঠনে তার রয়েছে অসমান্য অবদান। কিন্তু ভারতের জনগণ তথা দল-মত নির্বিশেষে সবাই আমাদের পক্ষে ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বলেই তার পক্ষে আমাদের সমর্থন দেওয়া সম্ভব হয়েছে। সেসময়ের ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বিতর্কগুলো পর্যালোচনা করলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে সরকারি ও বিরোধী দল সবাই বাঙালির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
 
লোকসভা ও রাজ্যসভার বিতর্কের জের ধরে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘এটা বাংলাদেশের জন্যই শুধু বিপজ্জনক নয় অথবা ভারতের একটি অংশর জন্যও নয়, বরং গোটা ভারতের জন্য বিপদ ডেনে এনেছে। শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং সমগ্র জনগণ তার পেছনে বিস্ময়করভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের সীমাহীন দুঃখ বেদনার সঙ্গে আমরা শুধু সহমর্মিতা প্রকাশ করছি না, তাদের দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্ত করার বিষয়টি আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট’।
 
২৭ মার্চ বিকাল ৪টায় আবার অধিবেশন বসে। দ্বিতীয় দিনের মতো আবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে কথা ওঠে। সদস্যরা বাংলাদেশ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় দিনে আবার কথা বলতে চাইলে স্পিকার বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর (আগের দিনই শ্রীমতি গান্ধী বক্তব্য দিয়েছেন) বিবৃতির পর আর কোনো আলোচনা চলতে পারেন না। কিন্তু শ্রীমতি গান্ধী স্পিকারকে অনুরোধ করে বলেন, ‘ব্যাতিক্রম হলেও এই হাউজে সদস্যদের গভীর অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ দেয়া উচিত’।

শ্রীমতি গান্ধী আরও বলেন, ‘Events have taken a different and tragic turn instead of peaceful evolutions there is now a bloody conflict. Our hearts go out in sympathy to the people who are undergoing great suffering’.
 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার সংগ্রামে বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সাহায্য কামনা করেছেন। শ্রীমতি গান্ধী লোকসভাকে আশ্বস্ত করেন যে, এই সংগ্রাম যদি অব্যাহত থাকে তাহলে অবশ্যই তারা আমাদের সম্ভাব্য সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন।
 
এদিন আলোচনার এক পর্যায়ে স্পিকার পিটিআই-এর একটি সংবাদ উদ্ধৃত করে বলেন, ‘এইমাত্র পাকিস্তান রেডিও সংবাদে জানা গেছে, শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হয়েছেন’। আলোচনার এক পর্যায়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘যারা নিপীড়িত নির্যাতিত তাদের অধিকার আদায়ে আমাদের কণ্ঠ সর্বদা সোচ্চার থাকবে। তিনি আরও বলেন, ‘I can assure the House that we shall keep in close touch with the situation and also we shall keep in close touch with the leader of the Opposition so that they can continue to give us their suggestions and we can also give them whatever knowledge we are able to.’ (মুক্তিযুদ্ধ: সিক্রেট ডিপ্লোম্যাসি, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ)
 
৩১ মার্চও লোকসভায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আলোচনা হয়। এদিন লোকসভায় বাংলাদেশে পাকিস্তান সৈন্যরা যে গণহত্যা চালাচ্ছে তা বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়। লোকসভার প্রস্তাবে বলা হয়, This house records its profound conviction that the historic upsurge of the 75 million people of East Bengal will triumph. This House wished to assure them that their struggle and sacrifices will receive the whole hearted symphathy and support of the people of India’. (মুক্তিযুদ্ধ: সিক্রেট ডিপ্লোম্যাসি, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ)
 
এভাবে মু্ক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহর থেকেই ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিরস্ত্র বাঙালির পাশে ছিলো। লোকসভা ও রাজ্যসভার প্রায় সব দল ও নেতারাই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। তারা সমস্বরে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১৭
এসএনএস

আগের পর্ব পড়ুন:
** স্বাধীনতার রক্ত-কথন
** ২৫ মার্চ অধিবেশন! অন্তরালে অপারেশন সার্চ লাইট
** ‘পাকিস্তান রক্ষা’র জন্য হানাদারদের ভুট্টোর আগাম অভিনন্দন
** শক্তির ভারসাম্য খেলায় দৃষ্টি যখন বাংলাদেশে
** স্বাধীনতার পথের বন্ধুরা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।