ঢাকা, সোমবার, ৩ আষাঢ় ১৪৩২, ১৬ জুন ২০২৫, ১৯ জিলহজ ১৪৪৬

মুক্তমত

যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়ালে কী করবে ইরান?

সিরাজুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:০৩, জুন ১৫, ২০২৫
যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়ালে কী করবে ইরান?

ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে আজ তিন দিন ধরে যুদ্ধ চলছে এবং যুদ্ধের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। ইসরায়েল আকস্মিকভাবে ইরানের ওপর হামলা চালায় এবং ভেতর থেকে মোসাদ সদস্যদের দিয়ে অন্তর্ঘাতমূলক আঘাত ও গুপ্তহত্যা চালায়, যার কারণে ইরান অনেকটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং এর মধ্য দিয়েই শুরু হয় যুদ্ধ।

প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ইরান ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং গত দুই দিন বিশেষ করে গত দুই রাতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়েছে। ইরানের এসব হামলায় ইসরায়েল অনেকটা নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে, তা আমরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কল্যাণে দেখতে পাচ্ছি। এর মধ্যে গত রাতে অর্থাৎ শনিবার দিবাগত রাতে ইরান একেবারে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে ইসরায়েলের ওপর হামলা চালিয়েছে এবং সেই হামলার ঘটনা ইরানি গণমাধ্যমসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে সম্প্রচার করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়—ইসরায়েলের বন্দরনগরী হাইফার ওপর মুহুর্মুহু ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানছে এবং একের পর এক ভবন ধসে পড়ছে। ইসরায়েলের বাম ইয়াত অঞ্চল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। গত তিন দিন ধরে ইসরায়েলের জনগণ বেশিরভাগ সময় বোম্ব শেল্টারে থাকছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েল ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার ওপর যে আগ্রাসন চালিয়ে আসছিল এবং গাজাকে যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, ইরানের হামলার কারণে এখন ইসরায়েলের লোকজন তার কিছুটা স্বাদ পাচ্ছে!

ইরানের প্রেস টিভি জানাচ্ছে, গত রাতে হাইফায় ইরান যে সমস্ত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে, তার মধ্যে একটি ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা প্রথমবারের মতো ইরান ব্যবহার করেছে। হাইফা হচ্ছে ইসরায়েলের প্রধান বন্দরনগরী। সেখানে রয়েছে ইসরায়েলের বেশিরভাগ তেল শোধনাগার। এ ছাড়া, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মজুদ স্থাপনা সেখানে অবস্থিত। হাইফা হচ্ছে ইসরায়েলের প্রধান ‘লাইফ লাইন’। জানা যাচ্ছে, গত রাতে ইরান যে হামলা চালিয়েছে, তাতে হাইফা বন্দরনগরীর একটি অ্যামোনিয়া গুদাম ধ্বংস হয়েছে। অ্যামোনিয়া হচ্ছে উচ্চমাত্রার একটি বিস্ফোরক পদার্থ, যা বোমা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অস্ত্র বানাতে ব্যবহৃত হয়।

ইরানের হামলায় এ পর্যন্ত ইসরায়েলের রাজধানীসহ বিভিন্ন শহর ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতিহাসে এর আগে এই ধরনের ক্ষয়ক্ষতির মুখে কখনোই ইসরায়েল পড়েনি। সেখানকার জনগণও এমন পরিস্থিতির মুখে কখনো পড়েছে বলে মনে হয় না।

ইরান ঘুরে দাঁড়িয়ে ইসরায়েলের ওপর এতটাই চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে যে, ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ওমানের মাধ্যমে ইরানকে যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে সেই প্রস্তাবে ইরান রাজি হয়নি। ইরান বলেছে, “ইসরায়েল যদি যুদ্ধ অব্যাহত না রাখতে পারে তাহলে যুদ্ধ শুরু করল কেন?”

আজকের একটি খবর থেকে জানা যাচ্ছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন—ইরান যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছে, তাতে তার কিছুই করার নেই। তার মানে আপাতত তিনি ইসরায়েলের এই দুরাবস্থা এড়িয়ে গেলেন, ইসরায়েলের দুঃসময়ে তিনি পাশে দাঁড়ালেন না। তবে চূড়ান্তভাবে ট্রাম্প এই অবস্থানে থাকতে পারবেন কি না, তা দেখার বিষয়।

প্রশ্ন হচ্ছে এই যুদ্ধ কি এখনই থামবে নাকি দীর্ঘায়িত হবে? বলা যায়, এ প্রশ্নের জবাব আজ ইরান দিয়ে দিয়েছে। ইরান বলেছে, ইসরায়েল যে আগ্রাসন শুরু করেছে, তা যদি বন্ধ করে তাহলে ইরান হামলা বন্ধ করবে। অবশ্য এই হামলা শুরুর আগে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের এটাই হবে সর্বশেষ অভিযান। অর্থাৎ এই অভিযানের ভেতর দিয়ে ইরান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এতটাই শক্তিশালী জবাব দেবে, যাতে ইসরায়েল আর ইরানের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। গত দুই দিনে ইরানি হামলার ধরন দেখে ব্যাপারটা তেমনই মনে হয়েছে। গত রাতে ইরান ইসরায়েলে যে পরিমাণে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, তাতে স্পষ্ট হয়েছে যে, ইসরায়েলের সামরিক এবং অর্থনৈতিক ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি না করে ইরান থামবে না। ইসরায়েলও ইরানের বিরুদ্ধে তাদের হামলা অব্যাহত রেখেছে। যদিও তারা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধের অনুরোধ জানাচ্ছে। কিন্তু খুব কার্যকর মধ্যস্থতা না হলে এই যুদ্ধ বন্ধ হবে—এমনটা ভাবার সুযোগ কম।

এই যুদ্ধ যথেষ্ট শক্তিমত্তা নিয়েই দুই পক্ষকে চালিয়ে যেতে হচ্ছে এই কারণে যে, যুদ্ধে যদি ইরান হেরে যায় তাহলে তার অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়বে। আর ইসরায়েল যদি এই যুদ্ধে হেরে যায় তাহলে তাদের সামরিক সক্ষমতা, তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর শক্তি ও দক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি মারাত্মকভাবে প্রশ্নের মুখে পড়বে। ইসরায়েলের সামরিক শক্তি প্রশ্নের মুখে পড়া মানেই মধ্যপ্রাচ্যে তার অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হবে। ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র কোনোমতেই ইসরায়েলের পরাজয় চাইবে না। আমরা এরইমধ্যে জানতে পেরেছি, ইরান ইসরায়েলের অন্তত তিনটি এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান ভূপাতিত করেছে। এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমারা প্রকাশ্যে ইরানকে খুব বড় শক্তি হিসেবে স্বীকার করে না। সেক্ষেত্রে কম শক্তির অধিকারী ইরানের হাতে যখন যুক্তরাষ্ট্রের গর্বের ধন এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান ধ্বংস হয় তখন এই বিমানের কার্যকারিতা নিয়ে মারাত্মক রকমের প্রশ্ন ওঠে, এটা স্বাভাবিক। ইরানের হাতে ইসরায়েলের জঙ্গিবিমান ভূপাতিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে এর শেয়ারমূল্য ৭ শতাংশ কমে গিয়েছিল। এ ছাড়া, পেন্টাগন চলতি বছরে লকহিড মার্টিন কোম্পানির কাছে ৪৮টি এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান চেয়েছিল, কিন্তু এখন তারা সেখান থেকে অর্ধেক বিমান নেবে। এর কারণ হচ্ছে, মার্কিন সামরিক বাহিনী এখন আর এফ-৩৫ জঙ্গিবিমানের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না।

এ ছাড়া, ইরান যে সমস্ত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার করে ইসরায়েলে হামলা চালাচ্ছে, তার মোকাবিলায় ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ডেভিড’স স্লিং বা আয়রন ডোমসহ অন্য কোনো ব্যবস্থা ভালো কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না। এ অবস্থায় যদি ইসরায়েল হেরে যায় তাহলে তার সামরিক অবস্থান মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হবে। সেজন্য তাকে এখন প্রাণপণে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। আবার ইরানকেও তার নিজের স্বার্থে, তার অবস্থান ধরে রাখার জন্য প্রাণপণে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। ফলে খুবই কার্যকর মধ্যস্থতা ছাড়া এই যুদ্ধ বন্ধের কোনো কারণ নেই।

প্রাণপণ লড়াইয়ের ভেতরে ইসরায়েল আরেকটি বিষয়ে তৎপর হয়েছে। সেটি হচ্ছে যারা এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো শক্তিকে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। তাতে লাভ হবে ইসরায়েলের। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এমন কিছু ঘটনা ঘটাতে পারে, যার কারণে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালাতে পারে। তখন শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে হবে, যেটা ইসরায়েল বিশেষভাবে চাইছে। যদি এই যুদ্ধে কোনভাবে যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটো জোটভুক্ত কোনো দেশ জড়িয়ে পড়ে তাহলে তাতে পুরো ন্যাটো জোটের জড়িয়ে পড়ার প্রশ্ন আসতে পারে। সেক্ষেত্রে ইরান কারো কারো সাহায্য চাইতে পারে। তখন এই যুদ্ধ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের রূপ নিতে পারে। এমনটি যদি হয় তাহলে তা হবে সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের জন্য বড় রকমের পরাজয়। সভ্যতার অস্তিত্ব নিশ্চিতভাবে হুমকির মুখে পড়বে।

চলমান যুদ্ধের নেপথ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের সম্মতি নিয়েই এই যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঘটনাচক্রে তারা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে। এমনটি হলে ইরানও ছেড়ে কথা বলবে না। ইরান আগেই বলে রেখেছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলকে হামলার ক্ষেত্রে সহায়তা করে তাহলে তারা মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালাবে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সকেও সতর্ক করেছে তেহরান।

এদিকে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ ইরানের প্রতি সম্পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করেছেন। ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলাকে রাশিয়া ও চীন অন্যায় বলে নিন্দা করেছে। শোনা যাচ্ছে, চীন থেকে কার্গো বিমান পাঠানো হয়েছে ইরানে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদি কৌশলগত চুক্তি রয়েছে ইরানের। অনেকেই হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছেন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ পশ্চিমা বহু দেশ ইসরায়েলের পক্ষে যুদ্ধ করতে পারে, ইরানের পাশে কে বা কারা দাঁড়াবে? এ প্রশ্নের জবাবে শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট হবে, ইরান কখনো কারো ওপর ভরসা করে কোনো কাজ করেনি বা করবে না। আর যুদ্ধ সে তো অনেক বড় বিষয়। ইরান তার নিজের শক্তি ওপর ভর করে যা করার তাই করবে। শুধু এইটুকু বলি, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়ালে সম্ভাব্য কী কী পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে, তার সবই হিসাব করে রেখেছে ইরান। ফলে কে তার সঙ্গে এলো বা এলো না— এসব বিষয় ইরানের কাছে একেবারেই গৌণ। মুখ্য যা, তা হলো উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। ইরান যুদ্ধ বেশ ভালোভাবেই সামাল দিচ্ছে এবং সম্ভাব্য যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত, সে কথা তারা আগেই ঘোষণা করে রেখেছে।

সিরাজুল ইসলাম: সিনিয়র সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।