ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ মে ২০২৪, ০৫ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

ঢাকা ও টঙ্গীতে ফেনসিডিল সাপ্লাই দিতেন আলী আকবর

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০২২
ঢাকা ও টঙ্গীতে ফেনসিডিল সাপ্লাই দিতেন আলী আকবর র‌্যাবের কবজায় আলী আকবরসহ তার সহযোগীরা।

ঢাকা: লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থানার একটি স্কুল থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন আলী আকবর (৩৫)। দরিদ্রতার কারণে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে তিনি এলাকার বিভিন্ন খাবার হোটেলে কাজ করতেন।

এক সময় তিনি ঢাকায় চলে আসেন। কাজ নেন ট্রাকের হেলপার হিসেবে। পাঁচ বছর ট্রাকের হেলপার থাকাকালীন মাদককারবারিদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন আলী আকবর। সেই থেকে মাদক পাচার ও পরিবহনের কাজে যুক্ত হন তিনি।

অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল অর্থের মালিক বনে যান আলী আকবর। মাদক পাচারে অর্জিত অর্থের আট লাখ টাকায় তিনি একটি জিপ কিনে। ওই জিপ ভাড়ায় চালানোর পাশাপাশি তিনি মাদক পরিবহন ও পাচারের কাজ করে আসছিলেন নিয়মিতভাবেই। তৈরি করেন নিজস্ব একটি মাদককারবারি চক্র। আর মাদক কারবারে অর্জিত টাকায় রামগঞ্জে বিঘায় বিঘায় জমি-সম্পত্তির মালিকও হন ওই আলী আকবর। দেশি-ভারতীয় ডিলারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি পরিচালনা করে আসছিলেন মাদকের কারবার।



সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ বন্দর এলাকা থেকে একটি কাভার্ডভ্যান (ঢাকা মেট্রো-ন-২৩-১২৯১) এবং একটি জিপের (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-৬৮৩৪) ভেতরে বিশেষ কায়দায় লুকানো অবস্থায় ১ হাজার ৪৬৫ বোতল ফেনসিডিলসহ চক্রের মূলহোতা আলী আকবর ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৩। গ্রেফতার তার দুই সহযোগী হলেন- রিপন মিয়া (২৭) ও মো. নুর হোসেন (৩৫)।

রোববার (১৬ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন রাবের অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব-৩ এর একটি দল শনিবার (১৫ অক্টোবর) দিবাগত রাতে নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে এই চক্রটিকে গ্রেফতার করে।

তিনি বলেন, গ্রেফতার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, জিপের মালিক আলী আকবর চক্রের মূলহোতা। কুমিল্লা থেকো নারায়ণগঞ্জে ফেনসিডিলের চালানটি পৌঁছে দেওয়ার জন্য আলী আকবরের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের এক ব্যক্তির চুক্তি হয়। চুক্তি মোতাবেক ১৫ অক্টোবর রাত ১০টায় রাজধানীর তেজগাঁও থেকো কুমিল্লার উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত জিপ নিয়ে রওয়ানা করেন আকবর। পরে কুমিল্লার সোয়াগাজী এলাকায় পৌঁছানোর পর জিপের মালিক আলী আকবর কুমিল্লার একটি হোটেলের সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন। এরই মধ্যে চক্রের পূর্ব-পরিচিত কাভার্ডভ্যানের ড্রাইভার নুর হোসেনকে ফোন করে কুমিল্লার সোয়াগাজী বাজারে অবস্থান করতে নির্দেশ দেন। কাভার্ডভ্যানটি সোয়াগাজী বাজারে এসে পৌঁছালে কুমিল্লা এলাকার ডিলার বস্তার ভেতরে ফেনসিডিল ভর্তি করে। পরে কাভার্ডভ্যানে ফেনসিডিল লোড করে দিয়ে সেটি তালাবদ্ধ করে দেয়। তারপর আলী আকবর জিপের ব্যাক ডালার ভেতরে বিশেষ কায়দায় তৈরি চেম্বারে ফেনসিডিল লোড করেন। এরপর তারা নারায়ণগঞ্জের এক ব্যক্তির কাছে মাদক সরবরাহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

র‍্যাব-৩ সিও বলেন, গ্রেফতার আলী আকবর মাদক কারবারের টাকায় জিপটি কিনেছেন আট লাখ টাকায়। দুই বছর ধরে ভাড়ায় জিপ চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করার আড়ালে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন তিনি।  

চোরাচালানে কৌশলী আলী আকবর ধরা পড়েননি কখনো

অধিক অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে আলী আকবর নিজের জিপসহ বিভিন্ন গাড়ি ভাড়া নিয়ে মাদক বহনের কাজ শুরু করেন। আলী আকবর যাত্রী বেশে এবং রিপন তার ড্রাইভার হিসেবে মাদকের চালানের বড় অংশ নিয়ে কাভার্ডভ্যানের পেছনে অবস্থান নেন। যাতে কাভার্ডভ্যানটি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আটক করলে তারা কৌশলে চালানের বড় অংশ নিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন। তার সহযোগী মাদক পরিবহনকারী যানটি যাতে নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন এবং মাদকের চালান ধরা পড়লেও তার নাম যেন প্রকাশ না পায় এজন্য তিনি মাদক পরিবহনকারী ড্রাইভারকে নির্দেশ দেওয়া থাকে। যে কারণে আগে কখনো আটক হননি কৌশলী আকবর। সহযোগীদের কেউ ধরা পড়লে তাদের আইনি সহায়তায় সহযোগিতা করতেন আকবর।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেফতার আলী আকবর নিজের জিপ থাকা সত্ত্বেও অধিক নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাভার্ডভ্যান, ট্রাক, পিকআপ ভাড়া করে মাদক পরিবহন করে থাকেন। ঘটনার দুই দিন আগে ফেনসিডিল পরিবহনের উদ্দেশ্যে আলী আকবর ও তার ড্রাইভার রিপন মিয়া কুমিল্লা যান। নুর হোসেন চালিত কাভার্ডভ্যানটি ২৫ হাজার টাকায় ভাড়া করে কুমিল্লার ডিলারের সাথে দরদাম করে আসেন।

র‌্যাব-৩ এর সিও বলেন, ফেনী-কুমিল্লাসহ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে রয়েছে ফেনসিডিলের ডিলার। তাদের কলে সীমান্তে যায় আকবরের গাড়ি। ফেনসিডিল বহনে কাভার্ডভ্যান ও জিপে বিশেষ চেম্বার তৈরি করা হয়। দেড় দুই কিলোমিটার সামনের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গতিবিধি রেকি করে চক্রের আলাদা টিম। আর এভাবেই ৪/৫টি জেলা পাড়ি দিয়ে আকবরের ফেনসিডিলের চালান পৌঁছে যায় নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা ও গাজীপুরের টঙ্গীতে।

সীমান্তে ডিলার কারা?

কোন কোন এলাকায় পাচার করা হয় ফেনসিডিল? জানতে চাইলে র‍্যাব-৩ অধিনায়ক বলেন, গ্রেফতার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, চক্রটি ফেনসিডিলের চালান কুমিল্লা জেলার সীমান্ত এলাকা থেকে সংগ্রহ করে রাজধানীসহ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী ও সাভারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিতেন। মূলত জিপের মালিক আলী আকবরের নেতৃত্বে চক্রটি পরিবহন ব্যবসার আড়ালে প্রতিবার ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে কুমিল্লা থেকে বিভিন্ন এলাকায় ফেনসিডিল পাচার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।

চক্রটি পণ্যবাহী পরিবহনের চালক ও সহকারীকে মোটা অংকের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের গাড়িতে ফেনসিডিল পরিবহনের জন্য প্রলুব্ধ করে থাকে। কুমিল্লার সোয়াগাজীর সিন্ডিকেট থেকে ফেনসিডিল সংগ্রহের পর কখনও আলী আকবর নিজে আবার কখনও তার নির্দেশনায় গ্রেফতার নুর হোসেন দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেন। গত ৩ বছর ধরে চক্র ৫০টির অধিক চালান দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিয়ে কোটি টাকা কামিয়েছে।

প্রতিটি চালানে ৫শ থেকে ১৫শ পর্যন্ত ফেনসিডিল ছিল। ওই চক্র ফেনসিডিলের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে গাঁজা ও ইয়াবার একাধিক চালান দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দেয়। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে চক্রের সদস্যরা এর আগেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি ফাঁকি দিতে সমর্থ হয়েছে।

গ্রেফতার রিপন মিয়া নীলফামারীর জলঢাকার একটি কলেজ থেকে ২০১০ সালে এইচএসসি পাস করেন। এইচএসসি পাস করার পর থেকে গ্রামে ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ শুরু করেন। পরে ২০১৫ সালে ঢাকা এসে বিভিন্ন গাড়ির হেলপার হিসেবে কাজ করেন। পরে নিজেই গাড়ি চালানো শিখেন এবং ২০১৭ সাল ২০১৯ সাল পর্যন্ত উবারে প্রাইভেটকার চালাতেন। এরপর তিনি একটি প্রাইভেট কোম্পানির কাভার্ডভ্যান চালান। তখন তিনি আলী আকবরের মাধ্যমে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি তার কোম্পানির কাভার্ডভ্যান দিয়ে একাধিক মাদকের চালান রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দেয়। মাদক পরিবহনের কৌশল হিসেবে আলী আকবর রিপনকে তার জিপের ড্রাইভার হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।

গ্রেফতার নুর হোসেন রামগঞ্জ এলাকা একটি স্কুল থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। ঢাকায় এসে দুই বছর বিভিন্ন খাবার হোটেলে কাজ করার পর ২০১৯ সাল পর্যন্ত ট্রাকের হেলপারি করে জীবিকা নির্বাহ করেন নুর হোসেন। এরপর তিনি নিজেই গাড়ি চালানো শিখে কিছুদিন পিকআপের ড্রাইভার হিসেবে এবং পরে কাভার্ডভ্যানচালক হিসেবে কাজ করেন। তখন আকবরের মাধ্যমে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন নুর হোসেন।  

গ্রেফতার আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান তিনি।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০২২
এসজেএ/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।