ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৯ মে ২০২৪, ১০ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

টিলাধসের মারাত্মক ঝুঁকিতে অর্ধশত পরিবার

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১২ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০২২
টিলাধসের মারাত্মক ঝুঁকিতে অর্ধশত পরিবার মারাত্মক ঝুঁকির মুখে টিলার এ বাড়িগুলো। ছবি: বাংলানিউজ

মৌলভীবাজার: তিলে তিলে গড়ে তোলা বসতবাড়িই মানুষের প্রশান্তির ঠিকানা। দিন শেষে কাজ থেকে ফিরে মানুষ এই বসতবাড়িতেই নিরাপদে বিশ্রাম নেয়।

কিন্তু সব বসতবাড়ি কি ঝুঁকিমুক্ত আর নিরাপদ থাকে? 

বসতবাড়ির স্থান নির্বাচনে সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবা না হলে সেই বাড়ি বা বাড়িগুলো থেকে যায় অনেকাংশেই ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোনো সময় তাতে মারাত্মক দুর্ঘটনায় হতে পারে প্রাণহানি।

শ্রীমঙ্গল উপজেলার কিছু কিছু চা বাগান টিলাময় অঞ্চলকেন্দ্রীয়। চা বাগান বেষ্টিত এই অঞ্চলে পাহাড়ি টিলা চা আবাদকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। তবে এই সব টিলাময় স্থানের আশেপাশে যারা বসবাস করেন তাদের জীবন পুরোপুরিভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। এর মর্মস্পর্শী উদাহারণ- গত শুক্রবার (১৯ আগস্ট) লাখাইছড়া চা বাগানের ঘর তৈরির লাল মাটি আনতে গিয়ে টিলাধসে ৪ নারী চা শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনাটি।

সম্প্রতি ওই এলাকায় সংবাদ সংগ্রহ করার এক ফাঁকে পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো পরিদর্শনে গেলে দেখা যায়, লাখাইছড়া চা বাগানের উড়িয়া টিয়ার ওপরে প্রায় অর্ধশত পরিবার বসবাস করছে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে। খাড়া টিলা বেয়ে ওপরে উঠে দেখা যায়– এখানে বসবাসকারী অধিবাসীরা নিজেরাই আতংকিত। সেখানকার অনেক ঘর মাটির তৈরি। কিছু বাঁশের বেড়া দিয়ে টিনের ছাউনির। টিলার মাটি ধসে পড়ায় সব ঘরই রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকিতে।

টিলার নিচে বাস করা শ্রমিকদের ঝুকিপূর্ণ বসতবাড়ি। ছবি: বাংলানিউজ

সেখানকার শ্রমিকরা বলছেন, ২০১২-১৩ সালে পাশের দৈত্যটিলা নামক স্থানে মাটি ধসে একই পরিবারের পাঁচজন মারা গিয়েছিল। আর গত শুক্রবার ১৯ আগস্ট উড়িষ্যাটিলার সুড়ঙ্গ থেকে ঘর লেপার মাটি সংগ্রহ করতে গিয়ে টিলাধসে একই পরিবারের দুজনসহ চার নারী চা শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় লাখাই চা বাগান এলাকার শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। টিলাধসের আশঙ্কা নিয়ে দিন পার করছেন তারা।

‘মিডিয়া এসেছে’ শুনে গৌরী তাঁতী ও সবিতা তাঁতী নামের মধ্যবয়েসী দুজন নারী মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে বলতে থাকেন- ‘শুক্রবার এখানে ৪ জন টিলাধসে মারা গেছে বলে সবাই আইছে। এতোদিন তারা কই ছিলো? আমরা যে ঝুঁকির মুখে বাস করি এগুলো তারা দেখে না? বাগানের সাহেব-বাবুকে আমরা বহুবার বলেছি, আমাদের এখান থেকে সরিয়ে দিতে, কিন্তু তারা আমাদের কারোর কথা শোনে না। ’

ওপরে উঠতেই এখানকার এলাকাবাসী রুবেল মল্লিক বলেন, আমরা এ এলাকায় ওপরে-নিচে মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট পরিবার আছি। প্রচুর বৃষ্টিপাত হলে আমরা খুব বেশি ভয়ে থাকি, কখন কি হয়?

আরো ওপরের দিকে যেতে যেতে একটি বিশাল আকৃতির গর্ত দেখা গেল। এই গর্তের মাটি ধসে নিচে পড়ে আছে। ওপরের শেষ মাথার দুপাশে টিনসেডের দুটি বাড়ি। মারাত্মক ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এই এলাকার প্রবীন ব্যক্তি সমীরণ বুনার্জি বলেন, দেখেন, ভালো করে দেখেন কী অবস্থায় আমরা আছি? যে কোনো সময় আমাদের বাড়িঘর মাটিচাপা পড়তে পারে। আমরা মারা যেতে পারি।

অপর একটি প্রান্তও এভাবে ধসে গেছে। ছবি: বাংলানিউজ

চা বাগানের প্রবেশমুখেই লাখাইছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা চম্পা দেব কথা প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি চন্দন কুমার তাঁতীর বাড়ি লাখাইছড়া টিলার ওপরে ছিল। পরে তিনি নিজের পরিবারের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অন্য জায়গায় চলে গেছেন। অল্প দূরে ডিগডিগা নামক সমতল ভূমিতে দু’বছর ধরে বাড়ি বানিয়ে সেখানে থাকছেন। তিনি সচেতন এবং সামর্থবান বলেই এটা করেছেন। তবে টিলার ওপরে বাসবাস করা চা শ্রমিকরা এ ব্যাপারে সচেতন নন এবং অর্থিকভাবে খুব বেশি দুর্বল।

টিলাধসে নিহত ৪ নারীর মধ্যে ২ নারীর তিনজন সন্তান লাখাইছড়া স. প্রা. বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে প্রধান শিক্ষিকা জানান।  

লাখাইছড়া ফিনলে টি কোম্পানির কালিঘাট চা বাগানের ফাঁড়ি বাগান। তারাই সেখানে চা শ্রমিকদের জন্য বসতি গড়ে তুলেছে। উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে বাস করা ওই পরিবারগুলোকে দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা মানছে না চা বাগান কর্তৃপক্ষ।

লাখাইছড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক সাদিকুর রহমান বলেন, আমরা খোঁজখবর রাখছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিবারগুলোকে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে।

সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রট সন্দ্বীপ তালুকদার বাংলানিউজকে বলেন, টিলাসংলগ্ন ঝুঁকিপূর্ণ বসতবাড়ি থেকে চা শ্রমিকদের সরিয়ে নিতে চা বাগান কর্তৃপক্ষকে আমরা বলেছি। এটা কিছুটা সময়ের ব্যাপার। দেখা যাক কী হয়?

বাংলাদেশ সময়: ২১০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০২২
বিবিবি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।