ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৬ মে ২০২৪, ০৭ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

১৫ হাজার টাকায় হতো প্রশ্ন ফাঁস, চক্র চালাতেন ৪ শিক্ষক

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০২২
১৫ হাজার টাকায় হতো প্রশ্ন ফাঁস, চক্র চালাতেন ৪ শিক্ষক

ঢাকা : রাজধানীর সেবা মহাবিদ্যালয়ের (নার্সিং কলেজ) প্রশিক্ষক ফরিদা খাতুন। কমপ্রিহেন্সিভ নার্সিং অ্যান্ড প্যাথফিজিওলজি বিষয়ে শিক্ষা দান করতেন তিনি।

প্রতিষ্ঠানটিতে গত ১০ বছর ধরে কাজ করে আসছিলেন তিনি। যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত নার্সিং কলেজগুলোর বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটি, মডারেটর ও ডিন কর্তৃক নির্বাচিত প্রশ্নপত্র প্রিন্টিং এবং প্যাকিংয়ে নিযুক্ত গোপন টিমে।

বড় এ দায়িত্বের সুযোগ নিয়ে অপকর্মে জড়ান ফরিদা খাতুন। শুরু করেন প্রশ্ন ফাঁস। নিজের সঙ্গে যুক্ত করে নেন নার্গিস ও মনোয়ারা নামে অপর দুই শিক্ষককে। অল্প সময়ে ব্যাপক অর্থের লোভে তারা তিনজন নার্সিং কলেজের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন পত্র ফাঁস করে আসছিলেন। একেকটি প্রশ্নপত্র ১৫ হাজার টাকা করে বিক্রি করতেন তারা।

গত শনিবার (২০ আগস্ট) ঢাবি অধিভুক্ত নার্সিং কলেজের ১ম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা হয়। এদিন পরীক্ষার বিষয় ছিল বিএসসি ইন নার্সিং (পোস্ট বেসিক)। কিন্তু পরীক্ষা শুরুর আগেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁস হয়। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এ ঘটনার প্রমাণ বের করে প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্যদের শনাক্ত করে। এর ধারাবাহিকতায় রোববার (২১ আগস্ট) রাতে রাজধানীর মহাখালী, ধানমন্ডি ও আজিমপুর এলাকায় অভিযান চালায় র‌্যাব।

অভিযানে আটক হন প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূলহোতা ফরিদা খাতুন (৫১)। আরও আটক হন চক্রের ছয় সদস্য। তারা হলেন- মোছা. মনোয়ারা খাতুন (৫২), মোসা. নার্গিস পারভীন (৪৭), মোছা. কোহিনুর বেগম (৬৫), মো. ইসমাইল হোসেন (৩৮) ও মো. আরিফুল ইসলাম (৩৭)। তাদের কাছ থেকে ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্রের কপি ও ৯টি মোবাইল জব্দ করে র‌্যাব।

পরে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১০ দলের এ অভিযানের বিষয়ে সোমবার (২২ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন আয়োজিত হয়। বাহিনীর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন।

কমান্ডার মইন বলেন, নার্সিং কলেজের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মুলহোতা ফরিদা খাতুন। তিনি চক্রের অপর সদস্য দুই সদস্য নার্গিস ও মনোয়ারা বেগমের মাধ্যমে শিক্ষকতা পেশার আড়ালে টাকার বিনিময় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছিলেন।

তিনি প্রশ্নপত্র প্রিন্টিং ও প্যাকিংয়ে নিযুক্ত গোপন টিমের সদস্য হওয়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগ নিয়েছিলেন। গত ১৩ আগস্ট তার সহযোগী নার্গিস ও মনোয়ারা বেগম কমপ্রিহেন্সিভ নার্সিং অ্যান্ড প্যাথফিজিওলজি বিষয়ের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র চান। প্রিন্টিং ও প্যাকিংয়ের সময় বিষয়টির প্রশ্ন সংগ্রহ করেন ফরিদা। পরে সেটি নার্গিস ও মনোয়ারাকে দেন। তারা চক্রের সদস্য ইসমাইলের মাধ্যমে কোহিনুর বেগমের কাছে প্রশ্নপত্রটি পাঠান। এর মধ্যে সুযোগ বুঝে ইসমাইল প্রশ্নের কিছু কপি নিজের কাছে রেখে দেন। টাকার বিনিময়ে সেসব প্রশ্ন তিনি ঘনিষ্ঠজনদের কাছেও বিক্রি করেন।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের এ পরিচালক আরও বলেন, চক্রের সদস্য কোহিনুর ও আরিফ এসব প্রশ্ন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পাঠান। এর বিনিময়ে অর্থ আদায়ও করতেন তারা। পরীক্ষা শুরুর আগেই শিক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্ন পৌঁছে যেত।

আটককৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা ৯৮টি নার্সিং কলেজের ৩৮টিতে পরীক্ষা চলছে। প্রশ্নপত্রের গোপনীয়তা বজায় রাখতে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন প্রশ্ন প্রণয়নকারী নিয়োগ দেওয়া হয়। যারা দুই সেট আলাদা প্রশ্নপত্র সরবরাহ করে থাকেন। পরে এই প্রশ্নপত্রগুলোকে যাচাই-বাচাই করার জন্য একটি মডারেটর টিম নিয়োগ করা হয়। যাদের কাজ হচ্ছে প্রশ্নপত্রগুলো থেকে পরীক্ষার জন্য এক সেট পরিপূর্ণ প্রশ্নপত্র তৈরি করে সেগুলো সিলগালার মাধ্যমে চিকিৎসা অনুষদের ডিনের কাছে জমা দেওয়া।

চিকিৎসা অনুষদের ডিন বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রের প্রশ্নপত্র সরবরাহের জন্য ৪ সদস্যদের একটি গোপনীয় টিম নিয়োগ করেন। যারা নির্বাচিত প্রশ্নপত্রটি প্রিন্টিং এবং প্যাকিংয়ে নিযুক্ত থেকে পরীক্ষা কেন্দ্রের চাহিদা অনুযায়ী প্রিন্ট করে আলাদা প্যাকিং করে তার উপরে কেন্দ্রের নাম লিখে সিলগালা করে দেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই প্রশ্নপত্রগুলো পরীক্ষার আগে বিভিন্ন কেন্দ্রে বিতরণ করে।

জিজ্ঞাসাবাদে ফরিদা জানান, তিনি, মনোয়ারা ও নার্গিস প্রায় ১০ বছর ধরে মহাখালী নার্সিং কলেজে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তারা আগেও বিভিন্ন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজগুলোর বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটি, মডারেটর ও ডিন কর্তৃক নির্বাচিত প্রশ্নপত্র প্রিন্টিং এবং প্যাকিংয়ে গোপন টিমের সদস্য ছিলেন।

কোহিনুর বেগম ২০০৮ সাল থেকে ঢাকার সরকারি নার্সিং কলেজে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত। ২০১৬ সালে অবসরে যাওয়ার পর একটি বেসরকারি নার্সিং কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগদান দেন। গ্রেফতার ইসমাইল হোসেন অন্য একটি নার্সিং কলেজের সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে কর্মরত। তার সহযোগী আরিফ নার্সিং কলেজের পোস্ট বেসিক বিএসসি ইন নার্সিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।

ইসমাইল ও আরিফ গত রোববারের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রটি  কোহিনুরের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। তারপর টাকার বিনিময়ে প্রশ্নটি অন্যান্য শিক্ষার্থীদের কাছে সরবরাহ করেন। ২০১৭ সালে সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অপরাধে গ্রেফতার হয়েছিলেন আরিফ।

কমান্ডার মইন বলেন, এ চক্রের আরও কয়েকজনের নাম আমরা জেনেছি। তাদের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ঢাবি কর্তৃপক্ষ চক্রটির সদস্যদের আটকে আন্তরিক সহায়তা করেছে।

ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দেখিয়ে কী পরিমাণ টাকার লেনদেন হয়েছে জানতে চাইলে খন্দকার আল মঈন বলেন, গত রোববারের কমপ্রিহেন্সিভ নার্সিং অ্যান্ড প্যাথফিজিওলজি বিষয়ে পরীক্ষার প্রশ্নটি কোহিনুরের কাছ থেকে নেওয়ার পর অন্যান্য শিক্ষার্থীদের কাছে অর্থের বিনিময়ে সরবরাহ করা হয়। আমরা আমরা বিভিন্ন ফুটপ্রিন্ট পেয়েছি। প্রশ্নপ্রতি ১৫ হাজার টাকা করে নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

আটককৃত এ চক্রের সদস্যদের ব্যাপারে আইনি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে বলেও জানান র‌্যাবের এ কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৮ ঘণ্টা আগস্ট ২২, ২০২২
এসজেএ/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।