ঢাকা: দেশি-বিদেশি নাগরিকের পদচারণায় সবসময় মুখর থাকতো রাজধানীর কূটনৈতিক পাড়াখ্যাত গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি। ২০১৬ সালের ১ জুলাই আর দশদিনের মতোই ব্যস্ত হয়ে পড়ে লেকের পাড়ের মনোরম পরিবেশের বেকারিটি।
তবে সন্ধ্যা গড়াতেই হলি আর্টিজানের আড্ডাস্থল পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেখানে চালানো হয় ইতিহাসের জঘন্যতম জঙ্গি হামলা। ভয়াবহ এ হামলায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ এবং প্রায় ১২ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস জিম্মি সংকটের ঘটনা স্তম্ভিত করেছিল পুরো জাতিকে।
ওই দিন রাত আটটার পর এ জঙ্গি হামলায় ২ পুলিশ কর্মকর্তা ও ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ নিহত হন ২২ জন। কয়েকবার প্রস্তুতি নেওয়ার পরও স্পর্শকাতর বিবেচনায় রাতে হলি আর্টিজানে অভিযান চালানো থেকে বিরত থাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো সদস্যদের পরিচালিত ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’ অবসান হয় জিম্মিদশার, নিহত হয় হামলাকারী ৫ জঙ্গি।
হলি আর্টিজানে হামলার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ফোর্সসহ প্রথমে পৌঁছান গুলশান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রিপন কুমার দাস। মামলার এজাহারে ঘটনার বিবরণীতে তিনি উল্লেখ করেন, ঘটনার দিন গুলশান থানার রোড নম্বর-৭১ থেকে ৯২ এবং এর আশপাশ এলাকায় পেট্রোল ডিউটির দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
রাত আনুমানিক পৌনে ৯টায় ওয়্যারলেসে ভেসে আসে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বেকারিতে গোলাগুলির খবর। খবর পেয়েই ফোর্সসহ রাত আনুমানিক ৮টা ৫০ মিনিটে ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে পৌঁছান এসআই রিপন। হলি আর্টিজানের কাছে উপস্থিত হয়ে তারা দেখতে পান, রেস্টুরেন্টের ভেতরে কতিপয় সন্ত্রাসীরা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপ করছে।
পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ ও এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ করতে থাকে। আত্মরক্ষার্থে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা পাল্টা গুলি চালায়। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীদের নিক্ষিপ্ত গুলি ও গ্রেনেডের আঘাতে এসআই ফারুক হোসেন ও কনস্টেবল প্রদীপ চন্দ্র দাস ও আলমগীর হোসেন মারাত্মক আহত হন। আহতদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয় এবং এসআই রিপন কুমার দাস বিষয়টি তাৎক্ষণিক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন।
যার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়াসহ ডিএমপির বিভিন্ন ইউনিটের অফিসার ও ফোর্স ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হয়। এরপর পুলিশসহ অন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হলি আর্টিজানের বেকারির চারপাশে কর্ডন করে ফেলে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সন্ত্রাসীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে সন্ত্রাসীরা তাদের লক্ষ্য করে অনবরত গ্রেনেড ও গুলি বর্ষণ করতে থাকে।
এ অবস্থায় রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টায় সন্ত্রাসীরা হলি আর্টিজান বেকারির পশ্চিম দিকের বাড়ির সামনে অবস্থানরত পুলিশ অফিসার ও ফোর্সদের লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ জন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য আহত হন, কেউ কেউ মারাত্মক আহত হন। এ সময় চারদিকে ঘিরে থাকা র্যাব-পুলিশসহ অন্য বাহিনীর সদস্যরা দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে যান। আহতদের সবাইকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১১টা ২০ মিনিটে বনানী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সালাহউদ্দিন খান মৃত্যুবরণ করেন। এর কিছুক্ষণ পরই ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) মো. রবিউল করিম নিহত হন।
এর মধ্যে পুলিশের আইজিপি ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, হলি আর্টিজানের ভেতরে অন্তত ২০ জন বিদেশিসহ কয়েকজন বাংলাদেশিও আটকা পড়েছেন। ভেতরে যারা আছেন, তাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য তারা বিপথগামীদের সঙ্গে কথা বলতে চান।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনা করে রাতেই পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর কমান্ডোরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সম্মিলিতভাবে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। নিরাপত্তার স্বার্থে ঘটনাস্থলের পাশ থেকে গণমাধ্যমকর্মীসহ সাধারণ মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে দেওয়া হয়।
রাত দেড়টার দিকে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী উল্লেখ করে পাঁচ তরুণের ছবি প্রকাশ করে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। জঙ্গিগোষ্ঠীর ইন্টারনেটভিত্তিক তৎপরতা নজরদারিতে যুক্ত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ এ তথ্য জানায়।
পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তক্রমে ২ জুলাই সকাল আনুমানিক ৭টা ৪০ মিনিটে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন জিম্মিদের উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করার লক্ষ্যে অভিযান পরিচালনা করে। ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যেই সব সন্ত্রাসীকে নির্মূল করে ওই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
অভিযানে নিহত জঙ্গিরা হলেন- মীর সামিহ মোবাশ্বের (১৯), রোহান ইমতিয়াজ (২০), নিবরাস ইসলাম (২০), খায়রুল ইসলাম পায়েল (২২), শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ (২৬)।
পরে জিম্মি থাকাবস্থায় সন্ত্রাসী কর্তৃক নৃশংসভাবে নিহত হওয়া ২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে ৯ জন ইতালির নাগরিক, ৭ জন জাপানের, ১ জন ভারতের ও ৩ জন বাংলাদেশি। সিআইডি ক্রাইম সিন বিভাগের সহায়তায় ঘটনাস্থল থেকে সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্যাদিসহ ভিকটিমদের ব্যক্তিগত মালামাল সাক্ষীদের মোকাবেলায় জব্দ করে নিজ হেফাজতে নেয় পুলিশ।
উদ্ধার জিম্মিদের বয়ান অনুযায়ী তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, জঙ্গিরা হামলার প্রথম ২০ মিনিটেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারা দেশি-বিদেশিদের গুলি করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে/গলাকেটে মৃত্যু নিশ্চিত করে। হত্যার পর ছবি তুলে অ্যাপের মাধ্যমে বাইরে অবস্থানরত নব্য জেএমবির নেতা তামিম চৌধুরী ও মারজানের কাছে পাঠায় তারা। তারা এতটাই নিষ্ঠুর ছিল যে, লাশের সারি মেঝেতে রেখেই খাবার খায়।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয় ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। বিচারিক কার্যক্রম শুরুর এক বছরের মধ্যেই ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন আদালত।
রায়ে মামলার ৮ আসামির ৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে বেকসুর খালাস দেন আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়।
দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ এবং মামুনুর রশিদ রিপন। এছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে বেকসুর খালাস দেন আদালত।
সিটিটিসির অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, প্রায় দেড় বছর আগে পরিকল্পনা এবং দীর্ঘ প্রস্তুতি শেষে নৃশংস এ হামলা সরাসরি বাস্তবায়নে দায়িত্ব দেওয়া হয় আত্মঘাতি পাঁচ জঙ্গিকে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে জেএমবির একটি গ্রুপ বিদেশিদের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নেয় ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। পরে ‘নব্য জেএমবি’ নামে পরিচিতি পাওয়া এ গ্রুপটির কথিত শুরাকমিটি গাইবান্ধার সাঘাটায় বৈঠক করে এই সিদ্ধান্ত নেয়।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, বাংলাদেশে তথাকথিত জিহাদ কায়েমের লক্ষ্যে জননিরাপত্তা বিপন্ন করার এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস’র দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য জেএমবির একাংশ নিয়ে গঠিত নব্য জেএমবির সদস্যরা গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় ও দানবীয় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হলি আর্টিজান হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদের উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্য বহির্প্রকাশ ঘটেছে। নিরপরাধ দেশি-বিদেশি মানুষ যখন রাতের খাবার খেতে হলি আর্টিজান বেকারিতে যায় তখনই আকস্মিকভাবে তাদের ওপর নেমে আসে জঙ্গিবাদের ভয়াল রূপ। জঙ্গি সন্ত্রাসীরা শিশুদের সামনে এ হত্যাকাণ্ড চালায়। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য জঙ্গিরা নিথর দেহগুলোকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায়। মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় হলি আর্টিজান বেকারি।
এখনো শেষ হয়নি বিচার কাজ
২০১৯ সালের ৩০ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৭ আসামির ডেথরেফারেন্স ও মামলার যাবতীয় নথি হাইকোর্টে আসে। এর পরেই প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই মামলার পেপারবুক প্রস্তুতের নির্দেশ দেন। এরপর আসামিরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে, আর রায়ে খালাস পাওয়া একজনের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এখনো মামলাটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন আর তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
হলি আর্টিজানের পর ধারাবাহিক অভিযান
হলি আর্টিজান হামলার পর দেশ থেকে জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদকে নির্মূল করতে এক যোগে অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। এর পর গত ৬ বছরে এক হাজারের বেশি অভিযানে গ্রেফতার করা হয় ২ হাজার ৪১০ জঙ্গিকে। উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদসহ গুরুত্বপূর্ণ নথি।
ছয় বছর পর বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ পরিস্থিতির সার্বিক অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সিটিটিসিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কল্যাণে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই মুহূর্তে বড় ধরনের কোনো জঙ্গি হামলার হুমকি ও আশঙ্কা কোনোটাই দেখছি না। সে ধরনের সক্ষমতাও জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেই। হলি আর্টিজান হামলার পর সব জঙ্গির সক্ষমতা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০২২
পিএম/এনএইচআর