ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সাভারে শিক্ষক হত্যা: ‘কিশোর গ্যাং’ লিডার ছিল সেই ছাত্র

সাগর ফরাজী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৯ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০২২
সাভারে শিক্ষক হত্যা: ‘কিশোর গ্যাং’ লিডার ছিল সেই ছাত্র উৎপল কুমার সরকার

সাভার (ঢাকা): শনিবার (২৫ জুন) দুপুরে হাজী ইউনুস আলী কলেজ (স্কুল) এর পঞ্চম শ্রেণির মেয়েদের আন্ত:শ্রেণি ক্রিকেট প্রতিযোগিতার প্রথম খেলাটি চলছিল। খেলাটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বিদ্যালয়ের পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ের শিক্ষক এবং শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি উৎপল কুমার সরকার (৩৭)।

মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে খেলাটি পরিচালনা করছিলেন তিনি। খেলাটির চার ওভার যখন চলছিলো ঠিক তখনই ওই স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম জিতু ওরফে ‘জিতু দাদা’ (১৭) একটি কাঠের স্ট্যাম্প দিয়ে হঠাৎ শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারের ওপর হামলা করে।

জিতু পেছন থেকে কয়েকটি আঘাত করার পর অন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাকে আটকাতে গেলে ফের উৎপল কুমারের পেটে ও মাথায় আঘাত করে কিশোর গ্যাং লিডার জিতু দাদা।

এদিকে এ ঘটনার মাঠের আরেক পাশে থেকে দেখেছেন মাঠে উপস্থিত থাকা স্কুলের অন্য শিক্ষক সমাজ কল্যাণ বিষয়ের প্রভাষক সফিকুল ইসলাম।  

সোমবার (২৭ জুন) আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকায় অবস্থিত স্কুলের প্রভাষক সফিকুল ইসলাম সেই দিনের নির্মম ঘটনাটির বর্ণনা দেন।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, যখন ঘটনাটি ঘটে তখন আমি মাঠের আরেক পাশে ছিলাম। আমি দেখেছি, তবে আমি যেতে যেতেই স্যারকে কয়েকটি আঘাত করে ফেলে জিতু। আমি জিতুর প্রতি রাগান্বিত হয়ে তাকে মারার জন্য হাত তুললে জিতু বলে উঠে ‘মেরে দেখ’। পরে জিতুর সঙ্গে কথা বাদ দিয়ে বাকি স্যারদের সঙ্গে নিয়ে প্রথমে উৎপল স্যারকে নারী ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সাভারের এনাম মেডিক্যাল নিয়ে গেলে একদিন পর উৎপল স্যার আইসিইউতে থাকা অবস্থায় মারা যান।

আশরাফুল ইসলাম জিতুর বিষয়ে জানতে চাইলে সফিকুল ইসলাম জানান, জিতু এমনিতেই বখাটে স্বভাবের। সে ছাত্র হিসেবেও বেশি ভালো না। এছাড়া নিয়মিত স্কুলে আসতো না। ছাত্র হিসেবে খারাপ হলেও সে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করতো। স্কুলের নিয়ম কানুনও মানতো না জিতু। এসব নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ অনেকবার বিচারে বসেছিল। এ সব বিচারেই শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার উপস্থিত থাকতেন। উৎপল কুমারসহ তারা অনেকভাবে জিতুকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। এমনকি জিতুর অভিভাবককেও বলেছেন কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। আজ সেই শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে জিতুর হাতেই। এছাড়া এ ঘটনার পর থেকে স্কুল বন্ধ রয়েছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সবাই একত্রিত হয়েছে। জিতুকে গ্রেফতার না করা পর্যন্ত স্কুল বন্ধ থাকবে।

সরজমিনে স্কুলে গিয়ে দেখা গেছে, স্কুলটির নাম হাজী ইউনুস আলী কলেজ। কলেজ হলেও স্কুলের কার্যক্রমও চলে প্রতিষ্ঠানটিতে। স্কুলটিতে ছোট একটি মাঠ আছে। মাঠের দুই পাশে দুটি সিসি টিভি ক্যামেরা রয়েছে। আরেক পাশে তিনতলা একটি ভবন রয়েছে সেখানেই শিক্ষা কার্যক্রম হয়। মাঠের পূর্ব পাশে সেই হামলার ঘটনায় রক্ত পড়ে থাকার চিহ্নও রয়েছে।

সিসি টিভি ক্যামেরার ফুটেজ চেক করতে গেলে স্কুলটির অফিস সহকারী আব্দুর আলিম বাংলানিউজকে বলেন, মাঠে আমদের দুইটা সিসি টিভি ক্যামেরা রয়েছে। এ ক্যামেরাতে ঘটনাটি স্পষ্ট ছবি আসতো। কিন্তু ঘটনাটি ঘটেছে দেড়টার দিকে। তখন বিদ্যুৎ ছিল না। বিদ্যুৎ না থাকায় সেই সময় ঘটনার কোনো ছবি বা ভিডিও পাওয়া যায়নি।  

জিতুর সহপাঠিরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলে, আমরা জিতুর বিভাগেই পড়ি। জিতু ভালো ছাত্র ছিল না। জিতুর আচরণও অনেকটা অন্যরকম। মনে হয় যে কোনো সময় যে কাউকে মারধর করবে। তার খুব প্রভাব ছিল, কোনো ছাত্র যদি তার কথা না শুনতো তাহলে তাদের ধরে শাস্তি দিতো। উৎপল স্যার এগুলো দেখে তাকে ধরে পিন্সিপালের কাছে অনেকবার নিয়ে গেছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।

এসময় স্কুলে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার জের টেনে এক ছাত্র বলে, কিছুদিন আগে আমাদের ফুটবল খেলা হয়েছে। সেখানে জোর করেই জিতু অধিনায়ক হয়েছে। সেই খেলায় জিতু জোর করে গোল দিয়েছে। আমরা কয়েকজন এটা নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাকেসহ আমার আরেক বন্ধুকে মারধর করেছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, জিতু আসলে অনেকটাই বেপরোয়া। তার সঙ্গে স্কুলের ছেলেদের চেয়ে বাইরের ছেলেদের চলাচল বেশি ছিল। অনেক রাত পর্যন্ত সে বাইরে থাকতো। তার নেতৃত্বে একটি গ্রুপ চলতো। সবার বসয় প্রায় ১৭ থেকে ১৮ এর ভেতর। কিশোর গ্যাংয়ের লিডারের মতই জিতুর চলাফেরা ছিল। জিতুকে সবাই ‘জিতু দাদা’ বলেই চিনে। তার ফেসবুকেও জিতু দাদা নাম রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বাংলানিউজকে বলেন, স্কুলটির পরিচালক মো. সুমন। তিনি জিতুর বাবা উজ্জ্বল হাজীর মামাতো ভাই। সেই ক্ষমতাই জিতুর ওপর কেউ কথা বলতে পারতো না। জিতু নানা অপকর্ম করে বেড়ায়। স্কুলে জিতুকে নিয়ে অনেকবার বসা হলেও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি শিক্ষকরা।

বিদ্যালয়টির অধ্যক্ষ মো. সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের স্কুল ও কলেজে ৫৫ জন শিক্ষক ও শিক্ষিকা রয়েছেন। উৎপল স্যার এখানে ২০১৩ সাল থেকে চাকরি করেন। স্যার আমাদের এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে করতেন। ঘটনার সময় আমি ছিলাম না। তবে ঘটনাটি শুনে দ্রুত স্কুলে এসে এ দুই দিন যাবৎ উৎপল স্যারের সঙ্গে হাসপাতালেই ছিলাম। স্যারের অপারেশনে ৩০ ব্যাগের মত রক্ত লেগেছে তবুও স্যারকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। যে ছেলেটা এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে সে একদমই ভালো ছেলে না। উৎপল স্যারই অনেক সময় আমার কাছে জিতুকে ধরে আনতো। তখন আমিসহ বাকি স্যাররা বিচার করতাম। এসব নিয়ে জিতুর অভিভাবককেও অনেকবার বলেছি কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।

জিতুর এই ঘটনায় বিদ্যালয় থেকে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা দুই দিন যাবৎ হাসপাতালেই ছিলাম। প্রাথমিকভাবে জিতুকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া পুলিশের পাশাপাশি আমরা স্কুল কর্তৃপক্ষ তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করবো।

উৎপল কুমার সরকার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আশুলিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন তার বড় ভাই আসীম কুমার সরকার।  

মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. এমদাদুল হক।  

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এ ঘটনায় নিহতের ভাই বাদি হয়ে জিতুকে আসামি করে আশুলিয়া থানায় একটি মামলা করেছেন। এখনও কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। আমরা অভিযানে আছি। খুব দ্রুত অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হবে।

আরও পড়ুন: ছাত্রের হামলায় আহত সেই শিক্ষক মারা গেছেন

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৬ ঘণ্টা, ২৮ জুন, ২০২২
এসএফ/এনএইচআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad