ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

ভূমি সেবা নিশ্চিত করা এখন নতুন চ্যালেঞ্জ  

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট   | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৬ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২২
ভূমি সেবা নিশ্চিত করা এখন নতুন চ্যালেঞ্জ  

রাজশাহী: কিছু দিন আগে ভূমি অফিসের একজন সার্ভেয়ারের প্রকাশ্যে ঘুষ নেওয়ার ভিডিও ফাঁস হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়লে তা ভাইরালও হয়।

পরে কঠোর সমালোচনার মুখে দুর্নীতিগ্রস্ত ওই কর্মকর্তাকে বর্তমান কর্মস্থল থেকে দুই দিনের মধ্যেই অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঘটনাটি ছিল রাজশাহীর তানোর উপজেলা ভূমি অফিসের। এ ঘটনায় রাজশাহীর অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) আবু তাহের মো. মাসুদ রানা অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে তানোর থেকে নাটোরের নলডাঙ্গা ভূমি অফিসে শাস্তিমূলক বদলির আদেশ দেন।

এই একটি ঘটনা ফাঁস হলেও ভূমি অফিসকে ঘিরে এমন অভিযোগ রয়েছে অসংখ্য। জনশ্রুতি আছে টাকা ছাড়া ভূমি অফিসে কোনো ফাইলই নড়ে না। সেখানকার গাছের পাতাও নাকি সেবা প্রত্যাশীদের কাছে টাকা চায়। ভূমি অফিসে ঢুকলেই পদে পদে হয়রানি। ভুলের পাহাড় চাপিয়ে দেওয়া হয় সেবাগ্রহীতার ওপর। তবে উৎকোচ দিলেই সব ভুল আবার মুহূর্তেই শুদ্ধ হয়ে যায়।  

সরকারি অন্যতম এই সেবা কার্যালয়ের চালচিত্র যখন এমন- তখন ‘সেবা প্রদানের প্রতিশ্রুতি’র মানদণ্ড সহজেই অনুমেয়। তবে এই কালো অধ্যায় থেকে বের হয়ে আসতে চায় সরকারি সেবামূলক এই প্রতিষ্ঠানটি। সরকারের জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের আওতায় আসতে আমূল পরিবর্তন আনা হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানের সার্বিক কার্যক্রমে। এরই মধ্যে ডিজিটালাইজেশন করা হচ্ছে বিভিন্ন ভূমি অফিস। ঘুষ, অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করে ভূমি সেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বর্তমানে দেশের চারটি বিভাগে ডিজিটালাইজেশন এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহী বিভাগ অন্যতম।  

তাই শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে ‘সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি’ এখন ভূমি অফিসের নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী সরকারি সেবাক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা, মান উন্নয়ন, সেবার মানদণ্ড নির্ধারণ ও সেবাপ্রাপ্তির অঙ্গীকার নিশ্চিতের মধ্যে দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে চায় এই প্রতিষ্ঠানটি। সেই দিকে পথ চলা শুরুর পরপরই অল্প সময়েই এগিয়ে গেছে অনেক দূর।

সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নাগরিকের প্রয়োজন ও প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবার মান নির্ধারণ, প্রয়োজন এবং সেবা প্রদানকারীদের ক্ষমতায় গুরুত্বারোপ, নাগরিক ও সেবা প্রদানকারীদের সম্পৃক্ত রাখা, নাগরিক এবং সরকারি কর্মকর্তাদের পারস্পরিক সহযোগিতায় উৎসাহিত করে উদ্দীপনা যোগাতে নতুন স্বপ্নের সূচনা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের গণকর্মচারীদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মূল্যায়নের জন্য সম্পূর্ণ ডিজিটাল ভূমি প্রশাসন ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে। হয়রানি ও ভোগান্তি এড়াতে সাবাইকে এখন ডিজিটাল ভূমি সেবা নেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে।

রাজশাহীর বোয়ালিয়া (বড়কুঠি) ভূমি অফিসকে এর মডেল হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়- আগের মতো আর দালালদের উপস্থিতি নেই। মূল ফটকেই রয়েছে বিশালাকার সিটিজেন চার্টার সাইনবোর্ড। সেখানে ৯টি পয়েন্টে এই ভূমি অফিসের সেবাসমূহ, সেবা গ্রহণের সময়, ফি এবং কী কী প্রয়োজনীয় কাগজপত্র লাগবে তার বিস্তারিতসহ বিভিন্ন সেবার তথ্য সাধারণ নাগরিকদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। কার্যালয়ে ঢুকতেই সরকার কর্তৃক জমির নামজারি ফি অর্থৎ কত টাকার কোর্ট ফি, নোটিশ জারি ফি, মিউটেশন খতিয়ান ফি তা লেখা রয়েছে। এর বাইরে কেউ কোনো টাকা দাবি করলে কোথায় অভিযোগ করতে হবে সেই কর্মকর্তার নাম ও মোবাইল নম্বরও দেওয়া আছে। কোথাও কোনো জটলা নেই। সেবা গ্রহীতারা নিয়ম মেনে সেবা নিচ্ছেন।

রাজশাহীর বোয়ালিয়া রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. শাহীন মিয়া জানান, গুণগত সেবা নিশ্চিত করতে তারা বদ্ধপরিকর। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অংশ হিসেবে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভূমি সেবাকে হাতের মুঠোয় আনা হয়েছে। ঘরে বসেই এখন সাধারণ মানুষ নিজের ভূমি সুরক্ষাসহ অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারছেন। এজন্য এক ঠিকানায় সকল ভূমি সেবা নিয়ে আসার জন্য স্থাপন করা হয়েছে land.gov.bd। এখন ভূমি অফিসে না এসেই ডিজিটাল ভূমি সেবা নেওয়া যাচ্ছে। কেবল এই অফিসেই নয়, রাজশাহী বিভাগের ৮টি জেলা ও ৬৮টি উপজেলার সকল ইউনিয়ন ও পৌর ভূমি অফিসেও ডিজিটাল সেবা কার্যক্রম মিলছে। এছাড়া ১৬২২২ এই কল সেন্টারের মাধ্যমে ভূমিসেবা এবং ডাকযোগে ভূমিসেবা দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান এই ভূমি কর্মকর্তা।  
রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মুহাম্মদ শরিফুল হক জানান, ডিজিটলাইজেশন হওয়ার পর সরকারি সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতির আওতায় রাজশাহী বিভাগে ৬৮টি উপজেলা ভূমি অফিসে প্রাপ্ত মোট ৯ লাখ ৬১ হাজার ১৮৪টি অনলাইন ই-নামজারি আবেদনের মধ্যে ৮ লাখ ৮০ হাজার ৩৬টি আবেদন এরই মধ্যে নিষ্পত্তি করা হয়েছে। অবশিষ্ট আবেদনগুলো নিষ্পত্তির জন্য বিভিন্ন ধাপে কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। রাজশাহী জেলায় ১০টি থানাউপজেলা ভূমি অফিসে প্রাপ্ত মোট ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৮৯টি অনলাইন ই-নামজারি আবেদনের মধ্যে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৬৮৭টি আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। অবশিষ্ট আবেদনগুলো নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধাপে কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। jm.lams.gov.bd ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জলমহাল ইজারার জন্য আবেদন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

এদিকে, ৭ হাজার ৩৬৪টি অধিগ্রহণ মামলার মধ্যে ৬ হাজার ৬১১টি মামলার তথ্য ও ভূমি তথ্য ব্যাংক এন্ট্রি সম্পন্ন হয়েছে। যা মোট মামলার ৯০ শতাংশ। এ বছর রাজশাহী জেলায় অনলাইনে ২০ হাজার ৬৭৫টি পর্চা প্রদান করা হয়েছে। অনলাইনে প্রাপ্ত আবেদনের ভিত্তিতে আবেদনকারীর নিজ ঠিকানায় ডাকযোগে খতিয়ান অথবা মৌজা ম্যাপ পাঠনোর কার্যক্রম শতভাগে উন্নীত করা হয়েছে। এখন অনলাইনেই ভূমি উন্নয়ন কর গ্রহণ করা হচ্ছে। রাজশাহী বিভাগে অনলাইনে ১০ হাজার ৫৭২টি দাখিলার মাধ্যমে মোট ২৫ লাখ ৪ হাজার ১৩৯ টাকা ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করা হয়েছে। রাজশাহী বিভাগের অনলাইনে দাখিল প্রদানের ক্ষেত্রে ‘রাজশাহী জেলা’র অবস্থান এখন ১ম।  

রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মুহাম্মদ শরিফুল হক জানান, ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সকল সব ধরনের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ‘সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি‘ বাস্তবায়নে তারা এখন দৃষ্টান্ত গড়ার পথে। ভূমি অফিসের এই অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২২
এসএস/এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।