ঢাকা, শনিবার, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ১১ মে ২০২৪, ০২ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

মৃত ৮ ও নিখোঁজ ৬ জেলের পরিবারে ঘোর অমানিশা

এস.এস শোহান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২২
মৃত ৮ ও নিখোঁজ ৬ জেলের পরিবারে ঘোর অমানিশা

বাগেরহাট: ঝড়ের কবলে পড়ে বঙ্গোপসাগরে ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হওয়া জেলেদের মধ্যে মফিজুল ইসলাম (৩২) নামে আরও এক জেলের মরদেহ পাওয়া গেছে।

বুধবার (৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবন সংলগ্ন কালিরচর এলাকা থেকে ভাসমান অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করেন স্থানীয় জেলেরা।

মফিজুল ইসলাম মোংলা উপজেলার বকুলতলা গ্রামের মো. রওশন আলী ছেলে।  

এ নিয়ে ট্রলার ডুবির ঘটনায় আট জেলের মরদেহ পাওয়া গেল। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ছয়জন।

এদিকে মৃত আট জেলের মধ্যে চারজনের বাড়িই কচুয়া উপজেলার বগা গ্রামে। এছাড়া নিখোঁজ ছয়জনের মধ্যে দুইজন এ গ্রামের।

বুধবার (৯ ফেব্রুয়ারি) বগা গ্রামে মৃতদের মরদেহ পৌঁছালে স্বজনদের কান্নায় আকাশ-বাতাশ ভারি হয়ে ওঠে। এলাকাবাসী ও আত্মীয়-স্বজনরা ছুটে আসেন মৃতদের বাড়িতে। স্বজনদের আহাজারি ও প্রতিবেশীদের চোখের পানিতে হৃদয় বিদারক দৃশ্য সৃষ্টি হয় বগা গ্রামে। কেউ ভাই, কেউ সন্তান, কেউ বাবা ও কেউ বা স্বামী হারিয়ে পাগল প্রায়। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম সদস্যকে হারিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন তারা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারাও ছুটে যান স্বজনহারাদের শান্তনা দিতে। মৃতদের পরিবারগুলোকে ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।

সকালে বগা গ্রামের নিহত রুহুল আমিনের বাড়িতে ঢুকতেই তার স্বজনদের আহাজারি চোখে পড়ে। ঘরের চাল থেকে দীর্ঘদিনের মরিচা ধরা টিনগুলো খসে পড়ছে। ঘরের বেড়াগুলোও জরাজীর্ণ। রুহুলের আয়ে কোনোমতে সংসার চলত তাদের। এ অবস্থায় রুহুলকে হারিয়ে সংকটে পড়েছে পরিবারটি। ১২ বছর বয়সী এখলাছ  ও আট বছর বয়সী ইয়াছিন নামে দু’টি সন্তান রয়েছে রুহুলের।

তোর স্ত্রী রুমিচা বেগম বলেন, ১ ফেব্রুয়ারি রাতে আনিস সরদারের এফবি মায়ের দোয়া ট্রলারে সাগরে ইলিশ ধরতে গিয়েছিলেন আমার স্বামী। আজ সে মরা অবস্থায় বাড়িতে ফিরল।  

দুইটা নাবাল্লোক (নাবালক) ছেলেরে কীভাবে লেখাপড়া করাব? কোথায় যাব? কার কাছে যাব ছেলেদের নিয়ে? শাশুড়িকে কীভাবে খাওয়াব? এভাবে বিলাপ করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি। এসময় এলাকার অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।

ট্রলারডুবির ঘটনায় রুহুলের প্রতিবেশী আবু বকর মোল্লা এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। তার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। আবু বকরের মা হাজেরা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, আগেও আমাদের এলাকার অনেকে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছে। কারও লাশ বাড়িতে এসেছে, আবার কারওটা আসে নাই। আমার বাবার (আবু বকর) লাশটা পাইলে বাড়িতে কবর দিতে পারতাম। যতদিন বেঁচে থাকতাম, বাবার কবর দেখেও মনকে বুঝ দিতে পারতাম। বাবার সন্তানদেরও বলতে পারতাম, তোমার বাবা এখানে শুয়ে আছে।

আবু বকরের স্ত্রী লামিয়া বেগম বলেন, আড়াই বছরের আয়শা ও তিন মাস বয়সী আবিদ নামে দু’টি সন্তান রয়েছে আমাদের। নিজেদের জমিও নেই। অন্যের জমিতে ঘর বানিয়ে থাকি। বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থাও খুব খারাপ। শিশু সন্তানদের নিয়ে এখন আমি কোথায় যাব?

শুধু রুহুল ও আবু বকরের পরিবার নয়, মৃত ও নিখোঁজ প্রত্যেকের পরিবারের একই অবস্থা। প্রত্যন্ত এ গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের পেশা সাগরে মাছ ধরা। দীর্ঘদিন ধরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ আহরণে গেলেও আর্থিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি তাদের। পেশাগত কাজে সাগরে থাকা অবস্থায় মারা গেলে বা আহত হলে কোনো সহযোগিতাও মেলে না। দরিদ্র পরিবারগুলোর অনেকের বাসস্থানেরও অভাব রয়েছে। এর আগে বিভিন্ন সময় যারা নিখোঁজ হয়েছেন, তাদের পরিবারগুলো পায়নি কোনো সহযোগিতা।

বগা গ্রামের মাছ ব্যবসায়ী ইব্রাহীম আমানী বলেন, আমাদের গ্রামটি মৎস্যজীবীদের গ্রাম। আমাদের বাপ-দাদার পেশা সাগরে মাছ ধরা। যুগের পর যুগ সাগরে মাছ ধরলেও আমাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। বিভিন্ন সময় মারাও যান অনেকে। এ ঝড়ে যারা মারা গেলেন, নিখোঁজ হলেন, তাদের পরিবারের তো আর কিছুই থাকল না। এসব পরিবারগুলোকে এমন একটি ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক, যাতে তাদের সন্তান ও স্বজনরা খেয়ে-পরে বাঁচতে পারেন। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে হতদরিদ্র জেলেদের পক্ষ থেকে আমি দাবি জানাই।

কচুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমা সরোয়ার বলেন, কেউ মারা গেলে উপজেলা পরিষদ থেকে যে সহযোগিতা করা হয়, তা খুবই সামান্য।  

এসব পরিবারকে পুনর্বাসিত করে তাদের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান এ জনপ্রতিনিধি।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, মৃত প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। এছাড়া যারা নিখোঁজ রয়েছেন, তাদের পরিবারকেও সহায়তা দেওয়া হবে।

শুক্রবার (০৪ ফেব্রুয়ারি) রাতে সাগরে মাছ ধরার সময় ঝড়ের কবলে পড়ে সুন্দবনের দুবলার শুটকি পল্লী এবং উপকূলীয় এলাকার অন্তত ২১টি ট্রলার ডুবে যায়। শনিবার সকালে ডুবে যাওয়া ১৬টি ট্রলার এবং দেড় শতাধিক জেলেকে সাগর থেকে জীবিত উদ্ধার করেন অন্য জেলেরা। এরপর শনিবার দু’জন, রোববার একজন, সোমবার দু’জন, মঙ্গলবার দু’জন ও বুধবার এক জেলের মরদেহ পাওয়া যায়।  

তারা হলেন- কচুয়া উপজেলার বগা গ্রামের উকিল উদ্দিনের ছেলে রুহুল হাওলাদার (৪২), সৈয়দ মল্লিকের ছেলে শহিদুল মল্লিক (৪০), সোনাম উদ্দিনের ছেলে ইয়াকুব আলী বাওয়ালী (২৮), ইউসুফ মোল্লার ছেলে মহিদ মোল্লা (৩৫), একই উপজেলার আন্ধারমানিক গ্রামের আনোয়ার হোসেন বাদল (৫০), বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার মামুন শেখ ও পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার ইসমাইল শেখ। ২০১৫ সালে বঙ্গোপসাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে এখনও বগা গ্রামের ১৯ জন নিখোঁজ রয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২২
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।