ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

অরক্ষিত ভ্রমণে পদ্মায় বাড়ছে নৌ-দুর্ঘটনা, মৃত্যু বাড়লেও টনক নড়ছে না

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২০
অরক্ষিত ভ্রমণে পদ্মায় বাড়ছে নৌ-দুর্ঘটনা, মৃত্যু বাড়লেও টনক নড়ছে না পদ্মানদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে নৌকায় ভ্রমণপিপাসুরা। ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: প্রমত্তা পদ্মানদী এখন পানিতে টইটুম্বর। নদীর সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে নদীপাড়ে প্রতিদিনই বাড়ছে ভ্রমণপিপাসুদের ভিড়।

রাজশাহী মহানগরীর টি-বাঁধ, আই বাঁধ, লালন শাহ্ মঞ্চসহ পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকা শহরক্ষা বাঁধজুড়ে কয়েকটি স্থান থেকে নৌকায় চড়ে ভ্রমণপিপাসুরা উত্তাল পদ্মার নদীবক্ষে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু নৌ-ভ্রমণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নিরাপত্তার তোয়াক্কা করা হচ্ছে না।  

অপ্রাপ্ত বয়স্ক নৌকাচালক, অদক্ষতা, ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ-তিনগুণ যাত্রী বহন করা, লাইফ জ্যাকেট পড়ে নৌ-ভ্রমণের নিয়ম না মানা, নৌ-চালানার নিরাপত্তা আইন অমান্য করাসহ নানা অব্যবস্থাপনার কারণে পদ্মায় একের পর এক নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই প্রতিদিন ভ্রমণপিপাসুরা ঘুরছেন মাঝনদীতে। এতে গেলে ৩ বছরে রাজশাহীর পদ্মায় নৌ-দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ১৬ জনের।  

সর্বশেষ শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) পদ্মায় নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে। ১৫ জন যাত্রী নিয়ে একটি নৌকা নদীতে ডুবে যায়। দুর্ঘটনায় ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এআইইউবি) বিবিএ তৃতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী সাদিয়া ইসলাম সূচনা ও তার ফুফাতো ভাই রিমন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, পদ্মা গর্ভেই তাদের সলিল সমাধি হয়েছে। রাজশাহী ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সপর ডুবুরি দল টানা তিনদিন খোঁজাখুঁজির পর তাদের হদিস না পেয়ে রোববার (২৭ সেপ্টেম্বর) উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করেছে।

পদ্মায় নৌ-দুর্ঘটনার পূর্ব ইতিহাস বলছে, গত তিন বছরে পদ্মায় নৌ-দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের। এছাড়াও নদীতে চলন্ত নৌকা থেকে যাত্রীদের পড়ে যাওয়ার ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছেই। ২০১৭ সালের মে মাসে মহানগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় ঝড়ের কবলে পড়ে পদ্মায় ডুবে মারা যান পাঁচজন। এরপর ২০১৮ সালে প্রাণ হারান অন্তত দুইজন।  

গত বছরের ১৫ জুলাই মহানগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় চলন্ত নৌকা থেকে পড়ে যান দুই তরুণী। নৌকার কাঠের বেঞ্চসহ উল্টে পড়ে যান তারা। এরপর এই বেঞ্চটাকেই আকড়ে ধরে বেঁচে যান তারা। পদ্মায় সাম্প্রতিককালের বড় দুর্ঘটনা ঘটে চলতি বছরের ৬ মার্চ। মহানগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় বর-কনেসহ ডুবে যায় দুটি নৌকা। এ ঘটনায় দুই শিশুসহ নয়জন মারা যান।

...পদ্মায় ঘুরতে আসা লোকজন, নৌ-চালক ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, রাজশাহীর পদ্মায় অন্তত ৩ হাজারের মতো নৌকা চলাচল করে। এর মধ্যে মাত্র ৬০০টি নৌকার অনুমোদন রয়েছে।  

পদ্মায় চলাচলকারী ডিঙি আকৃতির ইঞ্জিন চালিত নৌকাগুলো ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী বহন করে। শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) ডুবে যাওয়া নৌকাটিতে ধারণ ক্ষমতার চাইতে বেশি যাত্রী ওঠনো হয়েছিলো। সাধারণত ছোট নৌকাটি জেলেরা মাছ ধরার জন্য ব্যবহার করতো। আর বিকেলে তা নৌ-ভ্রমণপিপাশুদের সেবা দিতো। চলতি বছরের মার্চের দুর্ঘটনাও একই কারণে ঘটে।  

গত মার্চের নৌ-দুর্ঘটনার পর রাজশাহী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে নৌকায় যাত্রীপ্রতি একটি করে ‘লাইফ জ্যাকেট’ থাকা বাধ্যতামূলক করা এবং ছোট ডিঙি নৌকাগুলোতে লাইফ জ্যাকেট ছাড়া ৩ জনের বেশি যাত্রী না তোলার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে। তবে এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি!

নৌ-বিশ্লেষকরা বলছেন, পদ্মায় চলাচলকারী নৌ-যানে ত্রুটি, চালকের অদক্ষতা, ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা, নিরাপত্তা আইন অমান্য করা, চলার পথে দুই লঞ্চের মধ্যে প্রতিযোগিতা, বেপরোয়া চালানো, সম্ভাব্য দুর্ঘটনার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি না থাকার কারণে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। ঘটছে প্রাণহানি। এই সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান না হলে পদ্মায় দুর্ঘটনা বাড়তে থাকবে। বাড়বে প্রাণহানির ঘটনা।  

মহানগরীর টি-বাঁধ এলাকায় পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলাম বলেন, দায়িত্বশীল প্রত্যেকে দায়িত্ব পালন করলে দুর্ঘটনা থেকে হয়তো বাঁচতে পারবে। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে যে, দুর্ঘটনা কেন ঘটছে, কী কারণে ঘটেছে। এর জন্য যথার্থ ব্যবস্থা নিতে হবে।

...রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) অধ্যাপক মো. কামরুজ্জামান বলেন, দুর্ঘটনার জন্য চালকদের উদাসীনতা তো রয়েছে; পাশাপাশি প্রশাসনের দায়িত্বহীনতায়ও এর জন্য দায়ী। দুর্ঘটনার কারণগুলো খুঁজে বের করে সেগুলো সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এটাকে ফলোআপ করার জন্য মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করলে এই দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।   

রাজশাহীর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক আব্দুর রশিদ বলেন, রাজশাহীর পদ্মায় এখন স্রোত বেশি। বৃষ্টিপাত এবং ভারত থেকে আসা ঢলের কারণে স্রোত বেড়েছে। তাই নৌকায় চলাচলে কিছুটা ঝুঁকি রয়েছে।

রাজশাহী মহানগর নৌ-পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী মাসুদ বাংলানিউজকে বলেন, যাত্রীদের লাইফ জ্যাকেট না পরিয়ে নৌকায় উঠানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। লাইফ জ্যাকেট পরা বাধ্যতামূলক। সব নৌকায় যেন লাইফ জ্যাকেট থাকে সেটি নিশ্চিত করা হবে। এ বিষয়ে নৌকাচালক ও যাত্রীদের সতর্ক করতে আমরা ব্যবস্থা নেবো।

শুক্রবার নৌ-দুর্ঘটনা স্থল পরিদর্শন করেন রাজশাহী জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল। এ সময় নৌ-দুর্ঘটনা বিষয়ে জেলা প্রশাসন কি ব্যবস্থা নিবে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক নৌকা চালকরাই নিয়ম মেনে যাত্রী তুলছেন না। আবার অনেক যাত্রীই লাইফ জ্যাকেট পরছেন না। আমরা যাত্রীদের লাইফ জ্যাকেট পরাসহ সব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই। আমরা এ বিষয়ে খুব দ্রুত পদক্ষেপ নেবো।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২০
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।