ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

জলাতঙ্ক নির্মূলে ৫ লাখ কুকুরকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ

পাঠান সোহাগ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২০
জলাতঙ্ক নির্মূলে ৫ লাখ কুকুরকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: জলাতঙ্ক একটি ভয়ংকর মরণব্যাধি। এই রোগে মৃত্যুর হার শতভাগ।

বিশ্বে একজন এবং প্রতিবছর প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ জলাতঙ্ক রোগে মারা যায়। দেশে প্রতিবছর প্রায় চার থেকে পাঁচ লাখ মানুষ কুকুর, বিড়াল, শিয়ালের কামড় বা আঁচড়ের শিকার হয়। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু। এছাড়াও প্রায় ২৫ হাজার গবাদিপশু এই রোগের শিকার হয়ে থাকে।

জলাতঙ্ক রোগ থেকে রক্ষা পেতে বৈশ্বিক কর্মকৌশলে বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে এই অবহেলিত রোগটির বিরুদ্ধে জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচি পরিচালনা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা। দেশব্যাপী জলাতঙ্ক প্রতিষেধক টিকাদান (এমডিভি) কার্যক্রমের আওতায় ২০২০-২১ অর্থবছরে চারটি জেলায় প্রথম রাউন্ড ও ১৬টি জেলায় দ্বিতীয় রাউন্ডে আরও আনুমানিক পাঁচ লাখ কুকুরকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (সিডিসি) জুনোটিক ডিজিজ কন্টোল প্রোগ্রামের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শ ম গোলাম কায়ছার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সারাদেশে জলাতঙ্কে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ১৪৭ থেকে এক হাজার ৪৪৫ জনে নেমে এসেছে। সেটা ২০১৯ সালে কমে দুইশ জনে নেমে এসেছে এবং সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালেও এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা আগের তুলনায় প্রায় ৬৮ শতাংশ হ্রাস ১৪৮ থেকে ৪৯ জনে নেমেছে।

বিশ্ব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা এখন প্রায় জলাতঙ্কমুক্ত। সব কুকুর বাধ্যতামূলকভাবে টিকাপ্রাপ্ত। দক্ষিণ আমেরিকায় ব্যাপকহারে কুকুর টিকাদানের মাধ্যমে জলাতঙ্ক প্রায় নিয়ন্ত্রণে। জলাতঙ্ক এখন আফ্রিকা এবং এশিয়া তথা দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যা বেশি। বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ জলাতঙ্কে মৃত্যু এখন দুইটি মহাদেশে। শুধুমাত্র ভারতেই প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার লোক প্রতিবছর জলাতঙ্ক রোগের শিকার হয়। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানও একটা বড় অংশ বহন করে। বাংলাদেশেও ২০১০ সালের আগে প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার মানুষ জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতো এবং গবাদিপশুর মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান অজানা হলেও একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবাদিপশু এ রোগে মারা যায়।

জানা যায়, বৈশ্বিক কর্মকৌশলে বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে এই অবহেলিত রোগটির বিরুদ্ধে জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচি পরিচালনা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে জলাতঙ্কমুক্ত করার লক্ষ্যে ২০১০ সাল থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে জাতীয় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ এবং নির্মূল কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজ করছে। দেশের সব জেলায় মোট ৬৭টি জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এসব কেন্দ্র থেকে কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত রোগীর আধুনিক ব্যবস্থাপনা এবং জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অর্জনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে কুকুর কামড়জনিত জলাতঙ্কমুক্ত বিশ্ব হবে এ অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করছে।

সিডিসির জুনোটিক ডিজিজ কন্টোল প্রোগ্রামের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শ ম গোলাম কায়ছার এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে জানান, টিকার মাধ্যমে জলাতঙ্ক প্রতিরোধ হয়। এই সচেতনতা বাড়ার ফলে সারাদেশে ৬৭টি কেন্দ্রের মাধ্যমে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকার চাহিদা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০১২ সালে বিনামূল্যে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজারও বেশি রোগী টিকা পেয়েছে। ২০১৮ সালে তা বেড়ে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৪০৯-তে উন্নীত হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সিডিসির মাধ্যমে সারাদেশে প্রায় তিন লাখ ভায়াল টিকা দেশের বিভিন্ন জেলা সদর হাসপাতাল ও সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে দেওয়া হয়েছে।  

তিনি জানান, কুকুর/প্রাণীর আঁচড় বা কামড়ের পর টিকা দিলে জলাতঙ্ক প্রতিরোধ হয়। কিন্তু দেশ থেকে এই রোগ নির্মূলে প্রয়োজন কুকুরকে জলাতঙ্ক থেকে নিরাপদ করা। কোনো এলাকার শতকরা ৭০ শতাংশ কুকুরকে ব্যাপক হারে টিকা দিলে ওই এলাকার কুকুরের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়। তিন বছর পর পর তিন রাউন্ড টিকা দিলে কুকুর থেকে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর শরীরের সংক্রমণের হার শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে, যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।

২০২২ সালের প্রতি মিলিয়নে একজনের কম এবং ২০৩০ সালের মধ্যে জলাতঙ্কমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ব্যাপকহারে কুকুর টিকাদান কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা। ২০১১ সাল থেকে সারাদেশে ব্যাপকহারে কুকুর টিকাদান কার্যক্রম চালু করে এ প্রতিষ্ঠানটি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার তথ্যমতে, ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশব্যাপী কুকুরের জলাতঙ্ক প্রতিষেধক টিকাদান (এমডিভি) কার্যক্রমের আওতায় ৬৪টি জেলা সদর পৌরসভা ও ১০টি সিটি কর্পোরেশন এবং ৬০টি জেলার সব উপজেলায় ১ম রাউন্ডে টিকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, পাবনা, নীলফামারী জেলায় ২য় রাউন্ড এবং সিরাজগঞ্জ ও গাইবান্ধা জেলায় ৩য় রাউন্ড টিকাদান কার্যক্রমের আওতায় প্রায় ১৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪৩০টি কুকুরকে জলাতঙ্ক প্রতিষেধক টিকা দেওয়া হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে চারটি জেলায় প্রথম রাউন্ড ও ১৬টি জেলায় দ্বিতীয় রাউন্ড আরও আনুমানিক পাঁচ লাখ কুকুরকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে। এসব কার্যক্রমের পাশাপাশি জলাতঙ্ক রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম ও দিবস উদযাপনের মাধ্যমে অবহিতকরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও অপরিকল্পিতভাবে কুকুর নিধনরোধ করার লক্ষ্যে পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের সঙ্গে সমঝোতার স্মারক সই হয়েছে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, জলাতঙ্ক নির্মূলে কুকুরের টিকাদান কার্যক্রম চলছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে। এজন্য জনসচেতনতার বিকল্প নেই। তাই এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।

তিনি বলেন, জাতীয় সংসদের একটি আইন পাস হয়েছে। বেওয়ারিশ কুকুরকে মারা যাবে না। যেসব প্রাণীর কামড়ে বা আঁচড়ে জলাতঙ্ক রোগ হয় সেসব প্রাণীর সংখ্যা মানুষের থেকে নেহাত কম নয়। কুকুরকে মারতে গেলে প্রথমে ডায়াগনসিস করে প্রমাণ করতে হবে, যে এটা ক্ষতিকর প্রাণী। যা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই জলাতঙ্ক নির্মূলে কুকুরের টিকাদান করাটা সহজ কাজ।

এ রোগের ভয়াবহতা উপলব্ধি, জনসচেতনতা বাড়ানো এবং প্রতিরোধ ও নির্মূলের লক্ষ্যে ২০০৭ সাল থেকে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস উদযাপন হয়ে আসছে। পৃথিবীর ১২টি দেশের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশও ২০০৭ সালে প্রথম বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস উদযাপন করে। এরপর থেকে প্রতিবছর ২৮ সেপ্টেম্বর এ দিবস পালিত হয়ে আসছে এবং এরই অংশ হিসেবে সোমবার (২৮ সেপ্টেম্বর) বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস উদযাপন হবে। এবারের প্রতিপাদ্য- ‘জলাতঙ্ক নির্মূলে টিকাদান, পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ান’। এ দিবসটিকে ঘিরে বাংলাদেশ সরকার, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

এ কর্মসূচির আওতায় জাতীয়পর্যায়ে, বিভাগীয়পর্যায়ে, জেলা এবং উপজেলাপর্যায়ে একযোগে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস উদযাপন করা হয়। এ উপলক্ষে বিভিন্ন পর্যায়ে সেমিনার, মুক্ত আলোচনা, জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১০১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২০
পিএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।