বরিশাল: আগে নদীতে যেমন পানি ছিল তেমনি নৌযান চালানোও কঠিন ছিল। এখন প্রযুক্তিতে নৌযান চালানো সহজ হলেও নদীতে সেই আর পানি নেই।
দীর্ঘ ২৫ বছর আগে বাগেরহাট থেকে খুলনায় ট্রলার চালিয়ে যাওয়ার সময় থেকে তার শুরু হয় নদীর সঙ্গে সক্ষতা। এরপর ধীরে ধীরে কখনো মালবাহী, কখনো যাত্রীবাহী বড় বড় নৌযান চালিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। নিজের মেধা আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই আজ তিনি প্রথম শ্রেণির সনদপ্রাপ্ত মাস্টার। বেতন ভালো হওয়ায় এক কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত থেকে ঢাকা-বরিশাল রুটে নিরাপদে প্রায় এক দশক ধরে লঞ্চে যাত্রী পারাপারের কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন। তিন মেয়ে ও এক ছেলে সন্তানের জনক ৪৮ বছর বয়স্ক বেল্লাল সেপাই বাগেরহাট জেলার বাসিন্দা। যেখানে তার সাংসারিক জীবন। কিন্তু কর্মের কারণে বছরের বেশিরভাগ সময়টা পারবাত লঞ্চেই ভেসে থাকতে হয় তার। আজ সকালে যদি বরিশাল নদীবন্দরে থাকেন, কাল সকালে ঢাকার সদরঘাটে। রাতের বেলা জেগে থেকে লঞ্চ চালনা আর দিনের বেলায় কিছুটা সময় ঘুমিয়ে কাটান। এর বাইরে বাকিটা সময় জামা-কাপড় ধোয়া, খাওয়া-দাওয়া, ইবাদত করাসহ ব্যাচেলর জীবনের কাজকর্মে কাটে তার। আর তিন থেকে চার মাস পর পর যে ছুটিটা পান তা বাড়িতে গিয়ে কাটাতে না কাটাতেই আবার ফিরে আসতে হয় কর্মস্থলে। যদিও কর্মস্থলে ফিরে আসাটাই এখন তার আনন্দের। কারণ জীবন যুদ্ধে কর্মস্থলই তার কাছে এখন বেশি আপন।
অভিজ্ঞতার বরাত দিয়ে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, নদীগুলো এক সময় ছিল অনেক বড় ও গভীর। পানিতে টইটুম্বুর থাকা নদীগুলোতে স্রোতের টানও ছিল প্রচুর। বর্ষায় উত্তালও থাকতো ভয়ঙ্করভাবে। সনাতন বা ম্যানুয়াল প্রযুক্তিতে সে সময় লঞ্চ চালাতে হতো অভিজ্ঞতার জোরে, খালি চোখে দেখে। সে সময়টা কত কঠিন ছিল যে জাহাজ চালনা করেছে সে ছাড়া কেউ বুঝবে না। বর্তমান সময়ে এসে লঞ্চগুলোতে রাডার, ভিএইচএফ, ইকো সাউন্ডার, জিপিএস, হাইড্রোলিক হুইল, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিনসহ নানা প্রযুক্তির সংযোজন ঘটেছে। এতে নদীতে নৌযান চালনা অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু নদীতে সেই পানি আর নেই।
বেল্লাল বলেন, ঢাকা-বরিশাল রুটে সব নদী দেখতে ঠিকই বিশাল বিশাল, দেখলে মনে হয় কত পানি। কিন্তু নদীপথ অর্থাৎ যেখান থেকে মালবাহী ও যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল করে সে পথেই এখন পানি নেই। আর নদীর বাকি অংশের দশা তো আরও খারাপ। অর্থাৎ নাব্যতা সংকটই এখন নৌযান চালনাকে কঠিন করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, নাব্যতা সংকটের পাশাপাশি নৌপথে জেলেদের জাল আর মালবাহী বাল্কহেড চলাচল আরও ঝুঁকিপূর্ণ করেছে আমাদের জাহাজ চলাচলকে। নদী দেখতে বিশাল কিন্তু নৌপথটা তো নির্ধারিত। যেখানে খাড়ি অর্থাৎ গভীরতা বেশি থাকে। আর জেলেরা সেই খাড়িতেই জাল ফেলে রাখছে। ফলে তাদের জাল রক্ষা করতে গিয়ে অনেক সময় আমাদের নৌযানকে চরে উঠিয়ে দিতে হচ্ছে। তারপরও মালবাহী কার্গোগুলোতে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হলেও বাল্কহেডগুলো এখনও সনাতন পদ্বতিতে চলছে। যা প্রায়ই বিপদ ডেকে আনছে। সরকারের প্রতিটি উদ্যোগ সঠিকভাবে সবাইকেই মানতে হবে। কারণ গত কয়েক বছরে সরকারের নানা উদ্যোগে নৌযান চালনায় সুফল বয়ে এনেছে। এজন্য সমন্বিত উদ্যোগ নিলেই নৌপথ নিরাপদ ও শান্তিদায়ক হবে।
সম্প্রতি এ নৌপথ পরিদর্শন করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নদীর গতি প্রকৃতি বারবার পরিবর্তন হচ্ছে। একদিন আগে যা দেখে যাচ্ছি তা একদিন পরেই পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি নৌপথের মানুষগুলোর যাতায়াত সাশ্রয়ই ও নিরাপদ রাখতে। এজন্যই আমরা বারবার নদী পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শন করছি।
তিনি বলেন, আজকে আমরা ড্রেজিং করছি, কালকে আবার ভরাট হযে যাচ্ছে। এটা আমাদের ওপর নির্ভর করে না, এটা নদীর গতি প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। এখন বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে। আবার বড় বড় নদীর উপরে সেতু নির্মাণসহ বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন জায়গায় পলি পড়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে। এতে বিভিন্ন নদী পথ পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবর্তন হচ্ছে মানে এ নয় যে নৌপথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী বর্ধিত ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ আমরা বাস্তবায়ন করবো। এর লক্ষ্যে দেশের ৫৩টি নদী নতুনভাবে খনন করা হচ্ছে। আর যে নৌপথগুলো আছে সেগুলো নদী মেইনটেন্সে ড্রেজিং করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২০
এমএস/আরবি/