ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

মাত্র ৪ দিনেই তিস্তায় হারিয়ে গেল সিংগিমারী গ্রাম! 

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৪, ২০২০
মাত্র ৪ দিনেই তিস্তায় হারিয়ে গেল সিংগিমারী গ্রাম!  বাড়ির ভিটে হারিয়ে গেছে নদীগর্ভে, চলছে ঘর সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা, ছবি: বাংলানিউজ

লালমনিরহাট: তিস্তা নদীর বাম তীরের কিছুটা দূরেই গাছপালা আর ফসলে ভরা ছিল সিংগিমারী গ্রাম। বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত ছিল গ্রামটির অর্ধ সহস্রাধিক পরিবার।

কিন্তু মাত্র চারদিনের মধ্যে তিস্তার হিংস্র থাবায় মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে গ্রামটি।

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের দক্ষিণ বালাপাড়ায় ছিল সিংগিমারী গ্রাম। চারদিনের ব্যবধানে মঙ্গলবার (৪ আগস্ট) তা তিস্তা নদীতে পরিণত হয়েছে। ঈদের আনন্দে সারা বিশ্ব মেতে উঠলেও এ গ্রামে ছিল কান্নার রোল। গৃহহীনদের কান্নায় গ্রামটির বাতাস ভারী হলেও কর্তৃপক্ষের নজরেই আসেনি। ফলে গৃহহীনরা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটছে পাশের দক্ষিণ বালাপাড়া গ্রামের মানুষের। শুধু সিংগিমারী গ্রাম নয়, তিস্তার বাম তীরে গত দুই মাসে জেলার পাঁচটি উপজেলার প্রায় দেড় হাজার পরিবার তিস্তার ভাঙনের শিকার হয়েছে। তবে পুনর্বাসনের জন্য সরকারিভাবে মাত্র ২০৭টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা করা হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, চলতি মৌসুমে টানা কয়েক দফা বন্যায় ফসল নষ্টের পাশাপাশি পানিবন্দি থাকায় খাওয়ার জন্য সঞ্চিত অর্থ খরচ করেছেন। এখন সেই টাকাও শেষ। তাই খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে লালমনিরহাটের প্রায় ৩০ হাজার পরিবার। সেই ভয়াবহ বন্যার ধকল কাটতে না কাটতেই তিস্তা আবার আগ্রাসী হয়ে ওঠে। পানি কমে যাওয়ায় তিস্তার ভাঙন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে মাঠের পর মাঠ ফসলি জমি আর প্রিয় বসতভিটা। চোখের সামনে সাজানো ঘরবাড়ি তিস্তায় হারিয়ে যেতে দেখে কান্নার রোল পড়ে তিস্তা পাড়ে।  
এবারের ঈদুল আজহার আগের রাতে ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়ে সিংগিমারী গ্রাম। রাতেই ঘরবাড়ি সরাতে বাধ্য হন গ্রামবাসী। লোকজন আর নৌকার অভাবে সরাতে না পারায় আসবাবপত্রসহ পাঁচ-সাতটি ঘর তিস্তার স্রোতে ভেসে গেছে। গ্রামটির এন্তাজ ও মোকছেদসহ অনেকের ঘরবাড়ি তিস্তায় ভেসে গেছে। তারা রক্ষা করতে পারেননি সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। সর্বশেষ একমাত্র আব্দুল্লাহর বাড়িটিও মঙ্গলবার (০৪ আগস্ট) তিস্তায় বিলীন হয়েছে।  বাড়ির ভিটে হারিয়ে গেছে নদীগর্ভে, ছবি: বাংলানিউজ

এখন সিংগিমারী গ্রামটি তিস্তার স্রোত ধারায় পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ চেষ্টা করে ঘর খুলে পাশের ঈদগাহ, স্কুল মাঠ ও রাস্তার পাশে স্তুপ করে রেখেছেন। জমির অভাবে ঘর তুলতে পারছেন না ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তরা। চরা দামে ভাড়ায় জমি পাওয়া গেলেও তার মূল্য যোগানো অনেকের সাধ্যের বাইরে। তাই ঈদগাহ মাঠ বা রাস্তার পাশে পলিথিন সাঁটিয়ে অনেকেই মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। এমন চিত্র তিস্তার বাম তীরে অবস্থিত জেলার পাঁচটি উপজেলার গ্রামগুলোতে।

তিস্তার বাম তীরে সলেডি স্পার বাঁধ-১ এবং ২ এর মধ্যবর্তী অংশে গত এক মাস ধরে শত শত পরিবার ভাঙনের মুখে পড়েছেন। দু’টি বাঁধের মধ্যবর্তী অংশে হঠাৎ ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে সলেডি স্পার বাঁধ-২ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ (ওয়াপদা)। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে গেলে কয়েক হাজার হেক্টর ফসলি জমি, বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কয়েক হাজার পরিবার ভাঙন ঝুঁকিতে পড়বে। সিংগিমারী গ্রাম বিলীন হয়ে এবার ভাঙনের মুখে পড়েছে দক্ষিণ বালাপাড়া গ্রাম।  

এদিকে, ভাঙন রোধে জরুরিভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে সোমবার (৩ আগস্ট) নদীর তীরে মানববন্ধন করেছেন বালাপাড়ার সহস্রাধিক মানুষ। গ্রামটি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা। একইসঙ্গে ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত পুনর্বাসনের দাবি জানানো হয় মানববন্ধনে।  

ভাঙনের শিকার সিংগিমারী গ্রামের আজিজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সগায় (সবাই) ঈদের নামাজ পড়ছে আর হামরা (আমরা) ঘরবাড়ি সরাইছি। তারপরেও অনেকের ঘর ও জিনিসপত্র পানিতে ভাসি গেইছে। সরাবার পাই নাই। এখন ঘর তুলে থাকবার কোনো জমি নাই। ছাওয়া পোয়া (ছেলে-মেয়ে) নিয়া কোনটে যাই? কায় জায়গা দিবে? 

ওই গ্রামের এন্তাজ বাউদিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ঘর তো একা সরানো যায় না। লোকজন আর নৌকা খুঁজতে খুঁজতে দুইটা ঘর জিনিসপত্রসহ নদীতে ভাসি গেইছে। কিছুই বাঁচাতে পাই নাই। হামরা গরিব মানুষ। হামার ভিতি (আমাদের দিকে) কায়ো দেখে না ভাই। হামরা রিলিপ চাই না। নদী বান্দি (বাঁধ) দিলে হামরা কামাই (রোজগার) করি খামো। হামরা সরকারের কাছোত আর কিছু চাই না।  ঘর সরিয়ে রাখা হয়েছে ফাঁকা জমিতে, ছবি: বাংলানিউজ

পাশ থেকে দক্ষিণ বালাপাড়া গ্রামের শিক্ষক আব্দুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, তলদেশ ভরাট হওয়া তিস্তার ডান তীরে স্থায়ী বাঁধ থাকায় বাম তীরে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। ফলে তিস্তা প্রতি বছর বাম তীরের লোকালয়ে প্রবেশ করায় মূল স্রোতধারার গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। মাত্র চারদিনে সিংগিমারী গ্রামটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। দ্রুত বাঁধের ব্যবস্থা না করলে চলতি মাসেই দক্ষিণ বালাপাড়ার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কয়েক হাজার পরিবারের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হবে। তাই জরুরি ভিত্তিতে বাঁধ নির্মাণের দাবি জানাই।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর বাংলানিউজকে বলেন, নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ২০৭টি পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য পরিবার প্রতি সাত হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে। ঈদের পরে ভাঙনের শিকার পরিবারগুলোর তালিকা করতে উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভাঙন ঝুঁকিতে থাকা এলাকায় কাজ অব্যাহত রেখেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বালাপাড়া রক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে। তারা নদীপাড় পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২২ ঘণ্টা, আগস্ট ৪, ২০২০
এসআই


বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।