বৃদ্ধ দাদা রইছ আলীকে নিয়ে চলে তার সংসার। কোনো কাজ না পেয়ে পাথর শ্রমিকের কঠিন কাজ নামেন।
সিলেট সদর উপজেলার সাহেববাজারের মরহুম কামাল মিয়ার মেয়ে কলি বেগম কাজ করেন সিলেটের ধোপাগুল এলাকার একটি স্টোন ক্রাসারে।
কলির সাদাসিধে জবাব- কিতা কও? (কি বলো)। কাম (কাজ) করতে জান বারোইয়া (প্রাণ বেরিয়ে) যার। সংসার চলে না, আমরার আবার মে দিবস! ইতা দিয়া কিতা (কি) অইবো?
একই অভিব্যক্তি বৃদ্ধ পাথর শ্রমিক ষাটোর্ধ্ব আব্দুন নুরের। পাথরের শ্রমে বয়স যেনো আশি পেরিয়ে। মাথায় বোঝা উঠাতেই বুঝি প্রাণ যায়- মুখে ক্লান্তির দীর্ঘশ্বাসে এমনটি অনুমেয়।
জীবিকার তাগিদে প্রায় তিন বছর পাথর বহনের কঠিন কাজটি মাথা দিয়েই করে যাচ্ছেন হবিগঞ্জের বাসিন্দা আব্দুন নুর। চার সন্তান থাকলেও তাদের ধার ধারেন না তিনি। যে কারণে বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রীকে নিয়ে বইছেন সংসারের বোঝা।
দেখা মেলে একই এলাকার সদর উপজেলার হাটখোলা ইউনিয়নের শিশু রহমত আলীর (১৪)। সংসার চালাতে মা রোশনা বেগমের সঙ্গে কঠিন পরিশ্রমের কাজে নিয়োজিত এই শিশু। সিলেট এতিম স্কুলে ৪র্থ শ্রেণিতে অধ্যয়নের পর আর বিদ্যালয়মুখী হতে পারেনি রহমত। জীবিকার তাগিদে মায়ের সঙ্গে পাথর রাজ্যে কাটে সকাল থেকে সন্ধ্যা। দিন শেষে মজুরি হিসেবে শিশুটি পায় দেড়শ আর তার মায়ের রোজ ধরা হয় ২৫০ টাকা।
সমন্বিতভাবে এই টাকায় দিনে খেয়েপরে সংসার চালান মা-ছেলে। রহমতের বাবা আব্দুর রহিম পাথর শ্রমিকের কাজে নিয়োজিত থাকলেও বাবা-মায়ের সঙ্গে সংসার চালানোর সহায়তায় পরিশ্রমের কাজে নামতে হয় তাদের শিশু সন্তানকেও।
রুশনা বেগম বলেন, স্বামীর আয়ে সংসার চলে না। তাই ছেলেকে পড়ালেখা বাদ দিয়ে কাজে আনতে হয়। মে দিবসটি শ্রমিকদের জন্য হলেও রুশনার কথায় একদিন কাজ না করলে ভাত জুটবে না।
পাথর শ্রমিক আছমা বেগম বলেন, আমরা কাজ করলে খাই। কাজ না করলে অনাহারে থাকি। দিবস পালন করে আমাদের কি লাভ। কেউতো ঘরে এনে ভাত দেবে না। সারা দিন কাজ করে আড়াইশ টাকা পাই। তা দিয়ে সন্তানদের মুখে কোনোমতে ভাত দেই। একই মন্তব্য দিনমজুর পাথর শ্রমিক দিপন আহমদ, পারভেজ আহমদের।
সরেজমিনে পাথররাজ্য সিলেট সদর উপজেলার ধোপাগুল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সব শ্রেণীর নারী-পুরুষ কঠিন শ্রমে নিয়োজিত। সংসারের ঘানি টানতে শিশু সন্তানদের কাজে নামিয়েছেন অনেকে।
পাথররাজ্যের বাতাসে উড়ছে ধুলাবালি। সেই ধুলাবালিতে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শ্রমিক ও তাদের শিশু সন্তানরাও। শুধু সচেতনতার অভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পাথর শ্রমিক জনগোষ্ঠী। তাদের বেশির ভাগেই রোগে আক্রান্ত হন ঘন ঘন।
গোয়াইনঘাটের সাহেব বাজারের আহমদ আলী ও রইছ আলী বাংলানিউজকে বলেন, একেতো পরিশ্রমের কাজ। জীবিকার তাগিদে কাজ করি। অসুস্থ হলেও ধুলোবালি চিন্তা করলে হবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেটের বিভিন্ন পাথর কোয়ারিতে বাতাসে উড়ছে ধুলাবালি। শ্রমিকরা স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। শুধু ধোপাগুল এলাকাতেই অন্তত ১২ সহস্রাধিক শ্রমিক কর্মরত আছেন। সেসব শ্রমিকদের অনেকে দীর্ঘদিন কাজ করতে গিয়ে ধুলাবালিতে কঠিন রোগে আক্রান্ত। অনেকে মারাও গেছেন বলে জানা গেছে। তাদের জন্য মে দিবস বলতে কোনো কিছু নেই। শ্রমের ঘামের আয়ে চলে এসব শ্রমিকদের সপ্তাহ।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৫ মে ০১, ২০১৮
এনইউ/এএ