ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ঘানিতে ‘জীবনের ঘানি’

মবিনুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৫ ঘণ্টা, মে ১, ২০১৮
ঘানিতে ‘জীবনের ঘানি’ ঘানিতে রাজ্জাক/ছবি: বাংলানিউজ

রংপুর ঘুরে: ক্যাঁএচ… ক্যাঁএচ… ক্যাঁচর... ক্যাঁচর... শব্দে অবিরত ঘুরে চলেছে ঘানি। পাতাড়ি বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পাত্রে পড়ছে সরিষার তেল। ঘানির কাতাড়ির উপর উঠে বসে আছেন অশীতিপর আব্দুর রাজ্জাক। ঘুরছে ঘানি। সঙ্গে ঘুরছেন আব্দুর রাজ্জাকও। এই বয়সে এসেও ঘানিতে টেনে চলেছেন ‘জীবনের ঘানি’।

রংপুর জেলার গংগাচড়া উপজেলার মহিপুর রোডে গজঘণ্টা তালুক হাবু গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক। স্থানীয়ভাবে তাকে রাজ্জাক তেলী নামেই লোকে চেনে।

অনেক এলাকায় এ পেশার মানুষকে বলা হয় কলু। আর যে বলদ দিয়ে ঘানি ঘোরানো হয় তাকে বলা হয় কলুর বলদ।

আশির উপরে বয়স আব্দুর রাজ্জাকের। কোমর, পিঠ বাঁকা হয়ে গেছে। শরীরের কোথাও একটু মেদ নেই। চামড়ায় ভাঁজ পড়ে গেছে। মুখের দুই পাটিতে এবড়ো-থেবড়ো হয়ে এখনও কয়েকটি দাঁত অবশিষ্ট রয়েছে। গায়ে সারাক্ষণের সঙ্গী একটি গেঞ্জি। মানুষ এলে গায়ে গামছাটা জড়িয়ে নেন।

সরেজমিনে তালুক হাবু গ্রাম পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, সড়কের ধারেই দু’দিক খোলা এক চিলতে টিনের ঘরে আব্দুর রাজ্জাকের ঘানিঘর। হাড্ডিসার একটি গরু দিয়ে ঘানি ঘোরানো হচ্ছে। ঘানির প্রশস্ত তক্তাটির (যার নাম কাতাড়ি) উপর তিনি বসে আছেন। ঘুরছে কলুর বলদ, ঘুরছেন কলু আব্দুর রাজ্জাক।

একটু কথা বলতে চাইলে তিনি কাতাড়ি থেকে নেমে এলেন। সেখানে চড়ে বসলো তারই স্কুলপড়ুয়া ১২ বছরের নাতি আল মামুন। স্থানীয় তালুক হাবু দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে সে। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে নানার কাজে সহায়তা করে।
আল মামুনের বাবা-মা ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করেন। একমাত্র ছেলে আল মামুন নানার বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করছে।
৫ মেয়ে ২ ছেলে আব্দুর রাজ্জাকের। এ করেই সবার বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরা সবাই আলাদা। তাদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বাবার দিকে নজর দেওয়ার সময় তাদের নেই। স্ত্রী, এক মেয়ে আর নাতিকে নিয়ে চারজনের সংসার তার।
ঘানি বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘কেলাশ ফাইবে যখন পড়ি তখনই হামার বাপ হামাক ঘানিতে নাগিয়ে দ্যায়। সেই থ্যাইকাই তো ঘানি টানছি। ’

তিনি জানান, একসময় ঘানি ভাঙা তেলের কদর ছিল। দামও ভালো পাওয়া যেত। এখন ঘানির তেলের জায়গা দখল করে নিয়েছে কলের তেল। উদপাদন বেশি, দামও কম।

তিনি আরও জানান, একসময় এ গ্রামে ২০/২৫ জন তেলী ছিলেন। মোখলেছুর, সোবহান ও আলম নামে আরও তিনজন এ পেশায় এখনও জড়িত। কেউ মারা গেলে তার পরিবারের কেউ আর এ পেশায় আসে না। নতুন কেউ এ পেশায় আগ্রহ দেখায় না।

প্রতিবেশী আল আমিন জানান, ভর্তা কিংবা আচারের জন্য গ্রামের মানুষ এখন ঘানির তেলের উপর নির্ভরশীল। ঘানির তেলের দাম একটু বেশি হলেও খাঁটি জিনিসটি পাওয়া যায়।

সরিষা, বাদাম, তিসিসহ বিভিন্ন শস্য দানা থেকে তেল যে যন্ত্রের মাধ্যমে পেষাই করা হয় তাই ঘানি। এটিকে অনেকেই ঘানিকল, ঘানিগাছও বলেন। দেশের সব অঞ্চলেই আগে ঘানি দেখা যেত। তবে এটি এখন বিলুপ্তপ্রায় শিল্প।

ঘানি সম্পূর্ণই কাঠ দিয়ে তৈরি। এর প্রধান অংশকে বলে ‘গাছ’। আট থেকে দশ ফুট লম্বা গাছের অর্ধেকই মাটিতে পোঁতা থাকে। গাছের উপরে বেড় দেওয়া একটি অংশ থাকে তাকে ‘ওড়া’ বলে। এই ওড়াতেই সরিষা ঢালা হয়।

সরিষা পেষার জন্য এর মধ্যে মগুরের মতো একটি দণ্ড দেওয়া হয় একে বলে ‘জাইট’। জাইটের উপরের খোলা অংশ একটি বাঁকানো কাঠ দিয়ে টুপির মতো আটকিয়ে দেওয়া হয়। তাকে বলে ‘ডেকা’। ডেকার বাঁকানো নিম্নাংশ বড় একটি তক্তার সঙ্গে আটকানো। তাকে বলা হয় ‘কাতাড়ি’।

কাতাড়ির যে প্রান্ত গাছের সঙ্গে যুক্ত করা হয় তা অর্ধচন্দ্রাকারে কাটা হয়। এরপর গাছের কোমর বরাবর চারপাশ ঘিরে একটা খাঁজ কাটা হয়। যাতে কাতাড়িটি পড়ে না যায়। কাতাড়িটি ঘোরানোর জন্য অপরপ্রান্তে জুড়ে দেওয়া হয় গরু। কাতাড়ির উপর রাখা হয় পাথর কিংবা অন্য কোনো ভারী বস্তু। গাছের নিম্ন অংশে একটি ছিদ্র থাকে। উক্ত ছিদ্রের মাথায় একটি সরু কাঠ দেওয়া থাকে যাকে বলা হয় পাতাড়ি।

গরু চলতে শুরু করলে ডেকা জাইটটিকে ঘুরায়। আর সেখানে সরিষা কিংবা অন্যকোনো শস্য দানা পিষে হয়ে তেল বের হয়ে আসে। সেই তেল পাতাড়ি বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পাত্রে গিয়ে পড়ে।

ভালো জাতের সরিষা হলে প্রতি ৫ কেজি সরিষায় দেড় থেকে দুই কেজি অব্দি তেল পাওয়া যায়। দু’টি গরু হলে দিনে ২০/২৫ কেজি পর্যন্ত সরিষা ভাঙানো সম্ভব হয়। কিন্তু হাড্ডিসার একটি গরু দিয়ে আর কতই বা সরিষা ভাঙানো যায়। তাই অভাব আব্দুর রাজ্জাকের নিত্যসঙ্গী। আর এমনি অভাবের মধ্যদিয়ে জীবনের ঘানি টেনে চলেছেন আব্দুর রাজ্জাক।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৫ ঘণ্টা, মে ০১, ২০১৮
এমআই/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।