ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

নরসিংদীতে গুলিবিদ্ধ ২ ছাত্রদল নেতার মৃত্যু: হদিস মিলছে না কিলারের 

সুজন বর্মণ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৮ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০২৩
নরসিংদীতে গুলিবিদ্ধ ২ ছাত্রদল নেতার মৃত্যু: হদিস মিলছে না কিলারের  নিহত আশরাফুল ইসলাম ও সাদেকুর রহমান (ডানে)। ছবি- সুজন বর্মণ

নরসিংদী: নরসিংদীতে ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে বিরোধের জেরে সাদেকুর রহমান (৩২) ও আশরাফুল ইসলাম (২০) নামে গুলিবিদ্ধ দুই ছাত্রদল নেতার মৃত্যু হয়েছে। ঘটনার দুইদিন অতিবাহিত হলেও, হদিস মিলছে না গুলিবর্ষণকারী কিলারের।

বৃহস্পতিবার (২৫ মে) বিকেল ৪টার দিকে শহরের চিনিশপুরে বিএনপির কার্যালয়ের পাশে ছাত্রদলের পদবঞ্চিত নেতাকর্মীদের মোটরসাইকেল শোভাযাত্রায় সংঘর্ষে ওই গুলির ঘটনা ঘটে।

সংঘর্ষের পর গুলিবিদ্ধ দুজনকে উদ্ধার করে প্রথমে নরসিংদী জেলা হাসপাতালে এবং পরে অবস্থার অবনতি হলে, তাদের ঢাকা মেডিকেলে কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন সাদেকুরকে বৃহস্পতিবার (২৫ মে) সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। এরপর শুক্রবার (২৬ মে) সকালে মৃত্যু হয় আশরাফুলের। তবে এ ঘটনায় থানায় এখনো কোনো মামলা হয়নি।

নিহত সাদেকুর রহমান নরসিংদী জেলার হাজীপুর ইউনিয়নের বাদুয়াচর এলাকার আলাউদ্দিনের ছেলে ও জেলা ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এবং আশরাফুল ইসলাম শহরের সাটিরপাড়ার নাজমুল হকের ছেলে। তারা দুজনেই চলতি বছরের শুরুতে ঘোষিত জেলা ছাত্রদলের পদবঞ্চিত নেতা।

এদিকে গুলিতে নিহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে জেলাজুড়ে।  

এর আগে বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাতে সাদেকুরের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি মাইন উদ্দিনের নেতৃত্বে পদবঞ্চিত নেতারা শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। তারা এসময় জেলা বিএনপির আহ্বায়ক খায়রুল কবির খোকনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেন এবং সাদেকুর হত্যার বিচার দাবি করেন।  

এরপর রাত ১১টার দিকে হাজীপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি জায়েদুল কবির ভুঁইয়ার বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়ে এবং ককটেল নিক্ষেপ করে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নিযন্ত্রণে আনে বলে জানান ভুক্তভোগী জায়েদুল কবির।

এদিকে ঢামেক হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার (২৬ মে) বিকেলেই ওই দুজনের মরদেহ নরসিংদীতে তাদের বাড়িতে পৌঁছায়। এ সময় স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে পরিবেশ। কান্নারত নিহত সাদেকুর রহমানের মা শাহেলা খাতুন বলেন, ‘আমার বাবা কই? যারা আমার বাবাকে মারছে আমি তাদের বিচার চাই। ’

নিহতের বড় ভাই আলতাফ মেম্বার সাংবাদিকদের বলেন, নাহিদ, খায়রুল কবির খোকন, জায়েদুল, ইমান আলী এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। আমি এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার চাই।  

তিনি আরও বলেন, ‘আমি প্রথমে অপেক্ষা করবো আইন ভাইয়ের হত্যার বিচার করে কিনা। যদি না করে তাহলে আমিই ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিচার করবো। খায়রুল কবির খোকন কীভাবে নরসিংদীর মাটিতে পা রাখে, তা আমার দেখার আছে। ’

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিএনপি নেতা বলেন, বিএনপি যেখানে নরসিংদীর মাঠেই নামতে পারে না মিছিল সমাবেশ করতে, সেখানে মাইন উদ্দিন ও নিহত সাদেকের নেতৃত্বে ছাত্রদল প্রকাশ্যে মিছিল সমাবেশ করতে পারল কীভাবে? তাদের মিছিল সমাবেশে পুলিশ কেনো বাধা দিলো না?

জানা যায়, এর আগে গত ২০ মে দুপুরে প্রকাশ্যে চিনিশপুরে কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবীর খোকনের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন ছাত্রদলের পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা। খায়রুল কবির খোকনের কীভাবে বাড়িতে এর আগেও কয়েক দফা হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন তারা। এমনকি রায়পুরায় বিএনপি নেতার জানাজায় যাওয়ার পথে ইটাখোলায় খোকনের গাড়িবহরেও হামলা চালান তারা।

তবে এসব ঘটনাকে পেছনে ফেলে এখন আলোচনায়, কার ইঙ্গিতে এই জোড়া খুন সংঘটিত হলো, কারা গুলি করলো? নেপথ্যে কে ছিল? এসব প্রশ্নই এখন তাড়া করে বেড়াচ্ছে জনমনে।  

তাছাড়া জেলা ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। কিন্তু পদ বঞ্চিতরা বার বার কেনো খোকনের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর এবং তার গাড়িবহরে হামলা চালিয়েছে? এসব ঘটনার পেছনে কে কলকাঠি নাড়ছেন- এসব বিষয়ের উত্তর পেলেই এই জোড়া খুনের রহস্য উন্মোচিত হবে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।

গত বৃহস্পতিবারের (২৫ মে) শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা জানান, ছাত্রদলের কমিটি বাতিলের দাবিতে চার মাস ধরে তারা জেলা ছাত্রদলের সদ্য বহিষ্কৃত সহসভাপতি মাইন উদ্দিন ভুঁইয়ার নেতৃত্বে আন্দোলন করছেন। এরই অংশ হিসেবে ওইদিন (২৫ মে) জেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সাদেকুর রহমানের নেতৃত্বে তারা মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা বের করেন। এতে অন্তত ৫০টি মোটরসাইকেলে শতাধিক নেতাকর্মী অংশ নেন। শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণের পর জেলখানা মোড়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক পার হয়ে বিএনপির অস্থায়ী কার্যালয়ের দিকে যাচ্ছিল শোভাযাত্রাটি। এ সময় হঠাৎ তাদের ওপর গুলি করা হয়। এতে সাদেকুর মাথায় ও আশরাফুল পেটে গুলিবিদ্ধ হন।  

স্থানীয়রা ও শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া নেতাকর্মীরা গুলিবিদ্ধ দুজনসহ আহতদের উদ্ধার করে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট নরসিংদী জেলা হাসপাতালে নেন। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সাদেকুর ও আশরাফুলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান।

জেলা ছাত্রদলের পদবঞ্চিত নেতা ও সদ্য বহিষ্কৃত সহসভাপতি মাইন উদ্দিন ভুঁইয়ার অভিযোগ, মোটর শোভাযাত্রাটি খায়রুল কবির খোকনের বাসার সামনে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়া হয়। এতে সাদেকুর রহমানের মাথায় ও আশরাফুলের পেটে গুলি বিদ্ধ হয়।  

তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনের নির্দেশে জেলা ছাত্রদলের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, তার ভাই লাল, আল-আমিন, তানভির ও জায়েদুল কবিরের নেতৃত্বে এই ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনা নরসিংদীর জন্য অশনি সংকেত। আমরা তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে সুষ্ঠু বিচার চাই।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে জেলা ছাত্রদলের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে সিদ্দিকুর রহমান জানিয়েছেন, ঘটনার সময় তিনি ঢাকায় দলীয় সভায় ছিলেন। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এ ঘটনায় তাকে জড়ানো হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক খায়রুল কবির খোকন সাংবাদিকদের বলেন, জেলা ছাত্রদলের নতুন কমিটি হওয়ার পর থেকে পুলিশের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তারা আমাদের ওপর একের পর এক হামলা চালিয়ে আসছে। এখন তারা নিজেরাই এসব ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে বলছে।  

ছাত্রদলের কমিটি আমি ঘোষণা করি নাই উল্লেখ করে খায়রুল কবির খোকন বলেন, এই কমিটি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে দিয়েছে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি। এখানে তারা কেনো আমাকে দোষারোপ করছে?

ঘটনা সম্পর্কে জানতে জেলা পুলিশ ও থানা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তারা সাংবাদিকদের কল রিসিভ করেনি।

উল্লেখ্য, গত ২৬ জানুয়ারি সিদ্দিকুর রহমান নাহিদকে ছাত্রদলের সভাপতি, মাইনুদ্দিন ভুঁইয়াকে সিনিয়র সহ-সভাপতি ও মেহেদী হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা ছাত্রদলের ৫ সদস্য বিশিষ্ট (আংশিক) কমিটি অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। এরপর থেকে ঘোষিত কমিটি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছিল পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা।

এরই জেরে কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক খায়রুল কবীর খোকনের চিনিশপুরের বাসভবন তথা জেলা বিএনপির অস্থায়ী কার্যালয়ে একাধিকবার হামলার ঘটনা ঘটে।

বাংলাদেশ সময়: ১০২২ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০২৩
এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।