ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

রাজশাহী পুলিশ লাইনসে বয়ে গিয়েছিল রক্তবন্যা

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০২৩
রাজশাহী পুলিশ লাইনসে বয়ে গিয়েছিল রক্তবন্যা

রাজশাহী: আজ ২৫ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে রাজশাহী শহরের মোড়ে মোড়ে চলে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের মিছিল ও সমাবেশ।

দিনভর মুহুর্মুহু বিক্ষোভ চলে। এরপর দিনের সূর্য লাল আভা ছড়িয়ে পশ্চিমে অস্ত যাওয়ার পর নেমে আসে অন্ধকার। আর রাতের আঁধারে রাজশাহী পুলিশ লাইনসে হামলে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

এটিই ছিল প্রথম আঘাত। এর মধ্যে দিয়ে রাজশাহী আক্রমণ করে পাকিস্তানি হানাদাররা। গভীর রাতে পেছন থেকে অতর্কিত হামলায় দিশেহারা হয়ে পড়েন ঘুমন্ত পুলিশ সদস্যরা। এর পরও নিজেদের সবটুকু দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান। জীবন উৎসর্গ করে রক্ষা করেন পুলিশ লাইনস।

তাই ২৫ মার্চ এলে হানাদারদের সেই গুলির শব্দ যেন আজও ভেসে বেড়ায় পুলিশ লাইনসের আকাশে-বাতাশে। কারণ অগ্নিঝরা মার্চের স্মৃতিময় দিনগুলির সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটে এখানেই।

হানাদারদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর দুর্বার সংগ্রামের এক উজ্জ্বল প্রমাণ হচ্ছে রাজশাহী পুলিশ লাইনস। পুলিশ বাহিনীর সহযোগিতা না পাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে রাতের অন্ধকারে পুলিশ লাইনসে হামলা করে পাকিস্তানি বাহিনী। বৃষ্টির মতো চলে অবিরাম গুলি বর্ষণ। বিধ্বংসী গোলা ফেলা হয় আকাশ থেকেও।

সেদিন প্রাণ দিয়ে হলেও হামলার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন পুলিশ সদস্যরা। রাজশাহী রেঞ্জের তৎকালীন ডিআইজি মামুন মাহমুদ এবং এসপি শাহ আবদুল মজিদের বিচক্ষণতায় বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায় পুলিশ লাইনস। তবুও অতর্কিত হামলায় শহীদ হন অনেক পুলিশ সদস্য। পরে হত্যা করা হয় ডিআইজি মামুন মাহমুদ, শাহ আব্দুল মজিদসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে।



মার্চের সেই ঘটনার জন্য স্বাধীনতা দিবসে এসব শহীদ পুলিশ সদস্যদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে রাজশাহীর সর্বস্তরের মানুষ। পাকিস্তানি সরকারের সব ধরনের অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ অমান্য করেন রাজশাহী পুলিশ লাইনসের বীর সেনারা। ফলে ২৫ মার্চের কালো রাতেই সেনাদের হামলার শিকার হন তারা।

মুক্তিযুদ্ধকালীন ৭নং সেক্টরের চার নম্বর সাব সেক্টর কমান্ডার সফিকুর রহমান রাজা জানান, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী পুলিশ লাইনস দখলের জন্য পুলিশের ওপর অতর্কিত গুলি বর্ষণ করে। উভয় পক্ষের মধ্যে শুরু হয় গোলাগুলি। এ সময় পার্শ্ববর্তী এলাকার জনগণ পুলিশকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসে। শুরু হয় গুলি বিনিময়। ওই দিন পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। ২৬ মার্চ সারাদিনও গুলি চলে। ২৭ মার্চ সকাল থেকেই কারফিউ চলছিল সারা দেশে।  

সেই সাথে সকালে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠকে উভয় পক্ষের গোলাগুলি না করার মতামত ব্যক্ত করা হয়। কিন্তু কথা না রেখে ওই দিন দুপুর আড়াইটার দিকে শহর কাঁপিয়ে আবারও পাকিস্তানি সেনারা পুলিশ লাইনসে মর্টার শেলিং শুরু করে। পুলিশ লাইনস চত্বরে বয়ে যায় রক্তের বন্যা।

খবর শুনে আশপাশের লোকজন বেরিয়ে এসেছিলেন বাইরে। ২৮ মার্চ পর্যন্ত চলে গুলি বিনিময়। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদাররা রাজশাহী পুলিশ লাইনসের পতন ঘটাতে পারলো না। তারা বার বার বাঙালি পুলিশকে আত্মসর্মপণের জন্য চাপ দিচ্ছিল। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর বীর সদস্যরা আত্মসর্মপণের চেয়ে মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করে আপ্রাণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন। দুপুর ২টা পর্যন্ত অব্যাহত লড়াই চলে।

সাব সেক্টর কমান্ডার সফিকুর রহমান রাজা জানান, ওই সময় এতে প্রচুর সংখ্যক পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। সেনারা পদ্মা নদীর ধার দিয়ে বাঁধ অতিক্রম করে পুলিশ লাইনসে ঢুকে পড়ে এবং বহু জীবিত পুলিশকে হত্যা করে বেয়নেট চার্জ করে। পুলিশ সদস্যরা তখন বুঝতে পেরেছিলেন এ অসম যুদ্ধে তারা কোনভাবেই জয় পাবেন না। তারপরও বাঙালির মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য রাজশাহীতে প্রথম জীবন দিয়েছিলেন পুলিশ লাইনসের সদস্যরাই।

রাজশাহী শহীদ মামুন মাহমুদ পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ গোলাম মাওলা জানান, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শহীদ হন ডিআইজি মামুন মাহমুদ। ২৮ মার্চ যেসব পুলিশ শহীদ হয়েছিলেন তারা হলেন—আর্মড এসআই এনায়েত খান, পুলিশ কনস্টেবল ওসমান খান, আব্দুর রহমান, আক্কাস আলী, রইচ উদ্দিন, জয়নাল আবেদীন, আব্দুল মালেক, সিরাজুল ইসলাম, মেছের আলী, আলাউদ্দিন, আব্দুল হামিদ আব্দুল আজিজ মোল্লা, সাদেকুল ইসলাম, নিজাম উদ্দিন, একেএম সায়েম উদ্দিন, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন এবং রাজু ফজর। ৩১ মার্চ তৎকালীন রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টের ক্যাপ্টেন সোলেমান জিজ্ঞাসাবাদ করার নামে ডিআইজি মামুন মাহমুদ ও এসপি শাহ মোহাম্মদ আব্দুল মজিদকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে।

১১ এপ্রিল শহীদ হন এসআই দিলসাদ বিশ্বাস, ১২ এপ্রিল শহীদ হন হাবিলদার রমজান আলী, ১৪ এপ্রিল এসআই আফতাব উদ্দিন, ২১ এপ্রিল কনস্টেবল মোসলেম উদ্দিন, জব্বার আলী, আব্দুর রওফ, আব্দুল আজিজ, আব্দুল আজিজ, মহিউদ্দিন, আব্দুল হামিদ, আব্দুল ওয়াদুদ। ২৪ এপ্রিল শহীদ হন হাবিলদার রফিকুল ইসলাম, ২৮ এপ্রিল কনস্টেবল মীর আলাউদ্দিন, খন্দকার শাহজাহান এবং সুবেদার মোহাম্মদ আলী মন্ডল, ১২ মে শহীদ হন কনস্টেবল আব্দুল মাহমুদ, খোদা বখস, শামসুল হক, হযরত আলী, সোলায়মান সরজী এবং হাবিবুর রহমান। ১৪ মে শহীদ হন এসআই হেদায়েত আলী।

১৫ মে শহীদ হন হাবিলদার আব্দুস সাত্তার। ২০ মে কনেস্টবল ইজ্জত আলী এবং আফসার আলী। ১২ জুন শহীদ হন এসআই মহসীন আলী, ২১ জুন শহীদ হন হাবিলদার তামেজ আলী। ১২ জুলাই এএসআই এজাজ আলী এবং জিন্নাত আলী। ২১ অক্টোবর এসপি আয়েস উদ্দিন এবং বাবর আলী। ২০ নভেম্বর শহীদ হন আশরাফুল আনোয়ার এবং ২১ নভেম্বর শহীদ হন হাবিলদার মোসলেম আলী।

একাত্তরে রাজশাহী পুলিশ লাইনসের হামলার ঘটনায় কতজন মারা গিয়েছিলেন এর সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলেও একাধিক সূত্রের দাবি পুলিশ সদস্যসহ ওই সময় কয়েকশ’ ব্যক্তি শহীদ হয়েছিলেন।

রাজশাহী পুলিশ লাইনসে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে শহীদ জিআইজি মামুন মাহমুদ স্মরণে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শহীদ মামুন শাহমুদ স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এদের মধ্যে আত্মোৎসর্গকারী পুলিশ শহীদ হেড কস্টেবল তাজেম আলী, কনস্টেবল মোসলেম উদ্দিন, আর্মড পুলিশের এসআই এনায়েত খাঁন ও এসআই বাবর আলীর নামে পুলিশ লাইনসের ভিতরে চারটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।

পাকিস্তানি সেনাদের হাতে শহীদদের গণকবর রয়েছে রাজশাহী পুলিশ লাইনসের পূর্ব পাশেই। টানা নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে একাত্তরের ১৮ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় রাজশাহী। সেই দিনই রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দানে ওড়ানো হয় মানচিত্র খচিত স্বাধীন দেশের প্রথম লাল-সবুজ পতাকা। মুক্তিযুদ্ধে ঘটনাবহুল পুলিশ লাইনসের ভেতরে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ পুলিশ স্মরণে একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। এই স্তম্ভটি স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মহুতিদানকারী পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে আছে আজও।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০২৩
এসএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।