ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

লন্ডন

অ্যাডভেঞ্চার আমাজন-৫

আমাজনের আদিমানবের আতিথেয়তায়

সৈয়দ আনাস পাশা, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৫
আমাজনের আদিমানবের আতিথেয়তায় ছবি: মাহাথির পাশা ও নাহিয়ান পাশা/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

** অ্যাডভেঞ্চার আমাজন-১: পৃথিবীর ফুসফুসে এক স্রোতে দুই নদী, পানির রং ভিন্ন
** অ্যাডভেঞ্চার আমাজন-২: জাগুয়ার ও বিষাক্ত সাপের আতঙ্ক নিয়ে জঙ্গলে

** অ্যাডভেঞ্চার আমাজন-৩: কুমিরের আলোর চোখ, কাঁধে চড়লো অজগর!

** অ্যাডভেঞ্চার আমাজন-৪: আলসে শ্লথের দেখা, ছিপে ভয়ংকর পিরানহা শিকার

পূর্ব প্রকাশের পর
আমাজন জঙ্গল, ব্রাজিল থেকে:
প্রাগৌতিহাসিক যুগের সেই আদিম মানুষের মতোই জীবনযাপন তাদের। শরীরে কাপড় নেই।

গাছের পাতা ও এক ধরনের বেতের তৈরি পোশাক দিয়ে শরীরের নিম্নাংশ ঢাকা। আছেন গোষ্ঠীর একজন সর্দার।

আদিম মানুষের প্রতিনিধি আমাজন জঙ্গল মানবদের সঙ্গে সাক্ষাতে গেলে সেই সর্দার এসে প্রথমে স্বাগত জানান পর্যটক দলকে। তার নাম ডমিংগো। বয়স প্রায় ৬০/৬২ বছর হবে। গাছ-বন দিয়ে তৈরি বেশ বড় একটি হলরুমের মতো ঘরে নিয়ে ডমিংগো বসান সবাইকে। নিজ ভাষায় কথা বলছিলেন ডমিংগো, আর তা ইংরেজি ও পর্তুগিজে অনুবাদ করে মারকো জে লিমা শোনাচ্ছিলেন।

ডমিংগো নিজ ভাষায় কথা বলছেন, এমনটি জানিয়ে মারকো পর্যটকদের জানান, জঙ্গলের আদিবাসীদের এ ভাষার নাম ‘টুকানো’। আমাজনের সব আদিবাসীই এ ভাষায় কথা বলেন না, তাদের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা আছে। টুকানো ভাষায় কথা বলেন ব্রাজিলের মানাউস এলাকা সংলগ্ন আমাজনের প্রায় ৭শ কিলোমিটার এলাকার মানুষ।

‘হলরুমে’ অনেকটা আনুষ্ঠানিক সভার মতো পরিবেশ। প্রায় অর্ধশতাধিক জঙ্গলবাসীর উপস্থিতি। প্রথমেই ডমিংগো সংক্ষিপ্ত আনুষ্ঠানিক একটি বক্তব্য রাখলেন। বক্তব্যে তাদের ভুবনে আমাদের স্বাগত জানালেন তিনি।

বললেন, পর্যটকদের আনন্দ দিতে তারা তাদের ট্রাডিশনাল কিছু নাচ-গান পরিবেশন করবেন, যা সাধারণত তাদের বাড়িতে অতিথি আসলে তারা পরিবেশন করেন।

ডমিংগো জানান, তাদের ট্রাডিশনাল এসব পরিবেশনা শুধুই তাদের সংস্কৃতি নয়, এটি তাদের ধর্মীয় প্রার্থনারও একটি অংশ, যেটি দিয়ে দেবতার সঙ্গে যোগাযোগ সৃষ্টি হয় বলেই তারা বিশ্বাস করেন। গোত্র প্রধান ডমিংগোর বক্তৃতার পর শুরু হয় জঙ্গল মানবদের ট্রাডিশনাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এসব পরিবেশনায় নারী পুরুষ একসঙ্গে নাচলেন, গাইলেন।

পর্যটকদের সঙ্গে নিয়েও নৃত্য করলেন তারা। নাচার আগে ডমিংগো নিয়মও বলে দিলেন। জানালেন তার গোত্রের মেয়েরা পছন্দ করে একেকজন পুরুষ পর্যটককে নেবেন, পুরুষরা নেবেন মেয়ে পর্যটকদের। নাচবেন ও গাইবেন একসঙ্গে একজন আরেকজনের হাত ধরে। অবশ্য এতে অংশ নেওয়া বা না নেওয়া ইচ্ছে। অধিকাংশ পর্যটক অংশ নিলেন আদিবাসীদের ট্রাডিশনাল এ সাংস্কৃতিক পরিবেশনায়। ঘণ্টা দেড়েক আড্ডা শেষে জঙ্গল মানবদের কাছ থেকে বিদায়।
ফিরে আসার পথে আমাজন জঙ্গলের এই আদিবাসীদের সম্পর্কে বাংলানিউজকে অনেক তথ্য জানান মারকো। বলেন, যে মানুষগুলোর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো এরা আমাজন জঙ্গলের আদি মানুষ হলেও এই এলাকার না। আমাজনের কলম্বিয়া অংশেই এদের আদি নিবাস ছিলো। দক্ষিণ আমেরিকার মাদক ব্যবসায়ীদের যুদ্ধের শিকার হয়ে এরা কলম্বিয়া থেকে পালিয়ে এসে এখানে বসবাস করছে।

মারকো জানান, ড্রাগ যুদ্ধের কারণে দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ এখন শরণার্থীর জীবনযাপন করছেন। ড্রাগ ডিলিংয়ে জড়িত বিবাদমান গ্রুপের যুদ্ধের শিকার এসব মানুষ। ড্রাগ ডিলারদের সশস্ত্র যুদ্ধ থেকে নিজেদের জীবন বাচাঁতে এরা কলম্বিয়া থেকে পালিয়ে এসেছে আমাজনের ব্রাজিল অংশে।

কলম্বিয়ার ড্রাগ কিং হিসেবে পরিচিত পাবলো এস্কোভার সত্তর দশকের প্রথম দিকে ওই এলাকায় ড্রাগ ব্যবসার যে সূত্রপাত করেন, সেই ব্যবসাই এখন আমাজনের কলম্বিয়া অংশের আদি মানুষদের জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিলিয়ন ডলারের এ ব্যবসায় আধিপত্য বজায় রাখতে ড্রাগ ডিলারদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে নিয়মিতই বাঁধে যুদ্ধ। এসব যুদ্ধে ব্যবহৃত হয় আধুনিক মারণাস্ত্র। এরা এতোই শক্তিশালী যে কলম্বিয়ান সরকারও অনেকটা অসহায় এদের কাছে।

কথিত আছে, বিশ্বের শীর্ষ দশ ধনীর অন্যতম ড্রাগ কিং পাবলো এস্কোভার কলম্বিয়া সরকারকে একবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাকে যদি আইনের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া হয় তাহলে কলম্বিয়ার জাতীয় ঋণ সব তিনি পরিশোধ করে দেবেন। কিন্তু কলম্বিয়া সরকার তা মেনে নেয়নি। ১৯৯৩ সালে কলম্বিয়ান পুলিশের গুলিতেই ওই দুধর্ষ ড্রাগ কিংয়ের মৃত্যু হয়।

পাবলো এস্কোভারের শুরু করা ওই মাদক ব্যবসা এবং এতে আদিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা যুদ্ধ এখনও চলছে দক্ষিণ আমেরিকায়। মাদকের চাষ ও পাচারে আদিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বিবাদমান মাদক ব্যবসায়ী গ্রুপের মধ্যে সংগঠিত নিয়মিত এ যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিকার জঙ্গলের নিরীহ আদিবাসী মানুষ। এই যুদ্ধ থেকে প্রাণ বাঁচাতেই ব্রাজিল আমাজনে পালিয়ে এসেছিলেন ডমিংগো নেতৃত্বাধীন এই জঙ্গল মানবরা।

ডমিংগো গোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আচার-আচরণ সম্পর্কেও বাংলানিউজকে অনেক কিছু বললেন লিমা।

টুকানো ভাষায় কথা বলা এ গোষ্ঠীর নেতা নির্বাচন হয় বংশানুক্রমে। ডমিংগোর আগে তার বাবা, দাদা ছিলেন গোষ্ঠীর নেতা। গোষ্ঠীর কেউ যদি নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে বেরিয়ে যায়, তাহলে তাকে আবার ফিরতে হলে বেশ কয়েকটি পরীক্ষা দিয়ে নিজ সমাজে আবার ফিরতে হয়। ‘আমার এক ভাই ছিলো’ কথা প্রসঙ্গে ডমিংগো একবার এমনটি উচ্চারণ করলে, ‘ভাই ছিলো’ কথার মানে কি সে এখন আর নেই, মারকো’র কাছে এমনটি জানতে চাইলে ডমিংগোর পারিবারিক কিছু তথ্যও দেন মারকো।

তিনি বলেন, ডমিংগোর এক ভাই তাদের সমাজ থেকে বেরিয়ে গিয়ে মূলধারার সমাজে একটু ভালো চাকরি করছে। নিজ গোষ্ঠীর সঙ্গে সে এখন আর কোনো যোগাযোগ রাখে না। গোষ্ঠীরও তার সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। এ নিয়ে ডমিংগো পরিবারে একটি মানসিক কষ্ট আছে। এই কষ্টের কথা মাঝে মধ্যেই বলেন ডমিংগো। তবে এই ভাই যদি আবার নিজের আদি সমাজে ফিরতে চায় তবে তাকে বেশ কয়েকটি পরীক্ষা দিয়ে আদি সমাজে ফেরার জন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। ডমিংগো টুকানো ভাষায় নিজের এই কষ্টের গল্পই করছেন পর্যটকদের সঙ্গে।

জঙ্গলবাসী মানুষের এসব নিয়ম-কানুন থেকেই বোঝা গেলো কয়েকমাস আগে কিছু বাংলা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশি বংশোদ্ভ‍ূত একজন ব্রিটিশ তরুণীর আমাজন জঙ্গলের এক গোত্র প্রধান জঙ্গলমানবকে বিয়ে করার কাহিনী কতটুকু অনুমান নির্ভর ছিলো।

ব্রাজিলের আমাজন স্টেটে বসবাসরত বাঙালি তরুণ আবু সুফিয়ান উজ্জ্বল বাংলানিউজকে জানান, গোত্র প্রধান জঙ্গল মানুষকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এ ব্রিটিশ তরুণীর বিয়ের কাহিনী সঠিক নয়। আসলে ওই তরুণী ব্রিটিশ মূলধারার একটি টিভি চ্যানেলের জন্যে ডকুমেন্টারি তৈরির জন্য এসেছিলেন আমাজনে। নিজের ডকুমেন্টারি তৈরির স্বার্থে তাকে কয়েকদিন আমাজনের জঙ্গল মানুষের পোশাকআশাকে তাদের সঙ্গে বসবাস করতে হয়েছে।

আমাজনের এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আতিথেয়তা সত্যিই মুগ্ধ হওয়ার মতো। সভ্য সমাজের দাবিদারদের স্বার্থের যুদ্ধ তাদের বাস্তুভিটা ছাড়া করলেও এই সমাজের প্রতিনিধি পর্যটকদের প্রতি তাদের আতিথেয়তার কোনো কমতি ছিলো না।  

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৫
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

লন্ডন এর সর্বশেষ