ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ মে ২০২৪, ০১ জিলকদ ১৪৪৫

আইন ও আদালত

যে কারণে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়ছে অপরাধ

তারিকুল ইসলাম, ইবি করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৩
যে কারণে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়ছে অপরাধ

ইবি: সম্প্রতি খবরের শিরোনামে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)। সেখানে বাড়ছে অপরাধ।

বিশেষ করে ইবির আবাসিক হলগুলোতে র‌্যাগিং, নির্যাতন, মাদক সেবন, মারামারি, আধিপত্য বিস্তার - এসব অপরাধ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।

ইবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিমত, প্রভোস্টদের ক্যাম্পাসে অবস্থান না করাতেই এসব অপরাধ বাড়ছে। নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা বাদে আবাসিক হলের প্রভোস্ট কিংবা আবাসিক শিক্ষকদের ক্যাম্পাসে অনুপস্থিতিই শিক্ষার্থী নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটার সুযোগ তৈরি হয়।  

সম্প্রতি দুটো ঘটনায় উত্তাল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় সব গণমাধ্যমে গুরুত্ব দিয়েই ছাপা হচ্ছে ঘটনা দুটি এর ফলোআপ। তার মধ্যে একটি হলো ছাত্রী নির্যাতন ও অন্যটি উপাচার্যের কণ্ঠসদৃশ অডিও ফাঁস।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে ইবির দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ছাত্রলীগ নেত্রী অন্তরা ও তার সহযোগীদের টানা ৪ ঘণ্টা নির্যাতনের শিকার হন নবীন ছাত্রী ফুলপরী।  

এরইমধ্যে ফাঁস হয় ইবি উপাচার্যের কণ্ঠ সদৃশ বেশ কয়েকটি অডিও, যার জেরে ক্যাম্পসে চলছে উপাচার্য অপসারণের আন্দোলন।  

দুটো ঘটনায় উত্তপ্ত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। তবে র‌্যাগিংয়ে নামে ফুলপরীকে নির্যাতন সাম্প্রতিক সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর মধ্যে ন্যাক্কারজনক বলা হচ্ছে।

ইবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের বক্তব্য, ফুলপরীর ঘটনাটি প্রকাশ্যে এলেও অন্তরালে চলে যায় ইবির বিভিন্ন আবাসিক হলের এমন বহু নির্যাতনের ঘটনা। আরও অনেক নবীন শিক্ষার্থী র‌্যাগিং নামে নির্যাতনের শিকার হন। তারা প্রাণ ভয়ে কিংবা মানসম্মান হারানোর ভয়ে মুখ বুঝে নির্যাতন সহ্য করে নেয়। এসব ঘটনা আড়ালেই রয়ে যায়।

আর আবাসিক হলে র‍্যাগিং এর নামে নির্যাতন কিংবা হলের নানাবিধ সংকটের কারণ হিসেবে প্রভোস্টদের ক্যাম্পাসে অবস্থান না করাকেই দায়ী করেছেন অনেকে।  

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১২ ফেব্রুয়ারি যে হলে (দেশরত্ন শেখ হাসিনা হল) ফুলপরীর উপর নির্যাতন হয়, সে হল প্রশাসনে একজন প্রভোস্টের পাশাপাশি রয়েছে ৬ জন আবাসিক শিক্ষক। হল বডির দায়িত্বে থাকা প্রভোস্ট এবং ৬ জন আবাসিক শিক্ষক কেউই ক্যাম্পাসে থাকেন না। একজন আবাসিক শিক্ষক শৈলকুপা থাকেন। প্রভোস্টসহ বাকি ৫ জন থাকেন কুষ্টিয়া শহরে। অথচ ক্যাম্পাসে তাদের থাকার জন্য ওই হলের পাশেই রয়েছে ৫তলা ভবনের প্রভোস্ট কোয়ার্টার।  

অফিসের সময় শেষ হলেই প্রভোস্টরা চলে যান যার যার গন্তব্যে। ফলে জরুরি প্রয়োজনেও অনেক সময় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না।

শুধু দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলই নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য আবাসিক হলেও একই চিত্র।  

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি আবাসিক হল পরিচালনায় একজন করে প্রভোস্টের পাশাপাশি প্রতিটি হলে ৬ জন করে আবাসিক শিক্ষক থাকেন। আটটি হলের প্রভোস্টগণ সবাই থাকেন ক্যাম্পাসের বাইরে।  

হল প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা ক্যাম্পাসে অবস্থান না করায় যেমন শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকে, তেমনি হলে মাদক সেবন, র‍্যাগিং, নির্যাতনের মতো ভয়াবহ অপরাধের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

জানা গেছে, ক্যাম্পাস থেকে যথাক্রমে ২৪ ও ২২ কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ শহরে প্রভোস্টগণ অবস্থান করেন। আবার আট হলের ৪৮জন আবাসিক শিক্ষকের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন বাদে সবাই ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করছেন।

ফলে অফিস সময়ের পর কোনো শিক্ষার্থী বিপদে পড়লে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয় মোবাইল ফোনে। মোবাইল ফোনে সমস্যা সমাধানে তৈরি হয় দীর্ঘসূত্রিতা। আর এ দীর্ঘসূত্রিতায় ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের। অনেক সময় মোবাইল ফোনে পাওয়া না গেলে তৈরি হয় বড় ভোগান্তি।

শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, হলে খাবারের সমস্যা, পানির সমস্যা, ইন্টারনেট সমস্যাসহ যেকোন প্রয়োজনে প্রভোস্টদের ফোন করলেও তারা ঠিকমতো ফোন রিসিভ করেন না। তাই আমারা আমাদের সমস্যাগুলো কাউকে জানাতে পারি না। ক্লাস-পরীক্ষার টাইমে শুধু হল প্রশাসন মাঝে মধ্যে হল পরিদর্শন করতে আসেন।

বেগম খালেদা জিয়া হলের জান্নাতুল ফেরদৌস নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, সন্ধ্যা হলেই আমাদের হলে প্রবেশ করতে হয়। এরপর রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রভোস্টকে ফোন করে পাওয়া যায় না। প্রভোস্ট বা আবাসিক শিক্ষকদের অনুমতি ব্যতিত অ্যাম্বুলেন্সও আসতে পারে না। ফলে আমাদের নানা রকম ভোগান্তি পোহাতে হয়।

প্রভোস্টরা ক্যাম্পাসে না থাকায় গত ১২ ফেব্রুয়ারি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে নির্যাতনসহ এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। তাছাড়াও প্রতিনিয়ত নানা অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে হলগুলোতে।  

বিশেষ করে ছাত্রদের হলে রাত গড়ালেই হলের রুমে, করিডরে, ছাদেসহ বিভিন্ন জায়গায় মাদক সেবনের অভিযোগ আসে। কক্ষ, ছাদ বারান্দায় অবাধে মাদক সেবন করলেও বাধা দেওয়ার মতো কেউ থাকে না। এছাড়াও প্রতিনিয়ত হলের সিট নিয়ে মারামারি, হট্টগোলের মতো ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত।  

হলের প্রভোস্টরা ক্যাম্পাসে অবস্থান করলে এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড অনেকটাই কমে যেত বলে দাবি সাধারণ শিক্ষার্থীদের৷ এছাড়াও শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ কিছুটা হলেও লাঘব হতো বলে মনে করেন তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদ্দাম হোসেন হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, রুমে কিংবা ছাদে বসে মাদক সেবন করতে দেখি। আমরা কিছু বলতে পারি না। কারণ তারা ক্ষমতাসীন সংগঠনের রাজনীতি করে। প্রতিবাদ করতে গেলে আমাদের মারধর করে হল থেলে বের করে দেওয়ার হুমকি দেয়। এমনিতেই তুচ্ছ কারণে হলে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের মারধর করা হয়।

হল প্রশাসনের কাছে অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আসলে হল প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিয়ে লাভ হয় না। কারণ স্যাররা কেউই ক্যাম্পাসে থাকেন না। অভিযোগের সূত্র ধরে স্যাররা ক্যাম্পাস চলাকালীন হল তদারকিতে আসেন। তখন ক্লাস পরীক্ষা থাকে। বেশিরভাগ অপরাধ সংগঠিত হয় রাতে। রাতের বেলায় স্যাররা হল তদারকিতে আসলে অপরাধের সচিত্র দেখতে পারতেন। আর এটা সম্ভব হতো স্যাররা ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে পারলে। রাতের বেলা হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে আকস্মিক পরিদর্শনে আসলে হলে অপরাধের মাত্র অনেক কমে যেত।

এ বিষয়ে শেখ রাসেল হলের প্রভোস্ট ও প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক ড. দেবাশীষ শর্মা বলেন, এ সমস্যার সমাধান করা যাবে কি না তা বলতে পারছি না। তবে আমরা কয়েকদিন আগে প্রভোস্ট কাউন্সিলের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, প্রতিটি হলে প্রভোস্টদের সপ্তাহে একদিন রাত ৮টা পর্যন্ত অফিস করতে হবে। ওই হলের যাবতীয় সমস্যা পর্যবেক্ষণ করে ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করতে হবে। মার্চ মাস থেকেই এটা চালু হবে।

শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. পরেশ চন্দ্র বর্মন বলেন, দায়িত্ব নিয়ে যদি পালন করার সামর্থ্য না থাকে তাহলে সেসব দায়িত্ব না নেওয়াই ভালো। দায়িত্ব নিয়ে আমি সেটা যথাযথভাবে পালন করব না এটা কাম্য নয়। এভাবে পদ ধরে রাখার কোনো মানে নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, যারা দায়িত্ব নেবে তারা ক্যাম্পাসে থাকবে আমরা এমন একটা চিন্তা করছি। তবে আমাদের সীমাবদ্ধতাও আছে। যাকে প্রভোস্ট করব তিনি হয়ত ক্যাম্পাসে থাকতে রাজি না। তারপরও আমরা উৎসাহিত করছি। আমরা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে বিষয়গুলো দেখভাল করব। তবে আমাদের আরও সচেতন হওয়া দরকার। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করা দরকার। একে অপরকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া দরকার।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৩
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।