ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৮ রমজান ১৪৪৫

ইসলাম

খাদ্যদ্রব্যে ই-কোড ও তার ইসলামী বিধান

ইসলাম ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০২১
খাদ্যদ্রব্যে ই-কোড ও তার ইসলামী বিধান

বর্তমান বাজারে প্যাকেটজাত যেসব পণ্য পাওয়া যায় তার অনেকগুলোর লেবেলে উপাদান অংশতে কিছু ‘ই-কোড’  (E-code) বা ‘ই-নম্বর’ দেওয়া থাকে। এ ‘ই-কোডের ব্যাপারে বিভিন্ন বিপরীতমুখী বক্তব্য প্রচলিত রয়েছে।

যেমন: কারো কারো মতে, ই-কোডগুলো শূকরের নির্দেশ করে। অর্থাৎ ই-কোড মানেই হলো সংশ্লিষ্ট খাদ্যপণ্যে শূকরের কোনো না কোনো অংশ মিশ্রণ করা হয়েছে, তাই খাদ্যপণ্যটিও নাপাক বিবেচিত হবে এবং তা খাওয়া হালাল হবে না!

তবে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ই-কোড মৌলিকভাবে শূকরের নির্দেশ করে না; বরং ই-কোডের বাস্তবতা সম্পর্কে যে তথ্যাবলি সামনে এসেছে তা হলো, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী উৎপাদনকারীর জন্য প্যাকেটজাত খাদ্যদ্রবের গায়ে বেশ কিছু বিষয়ের তথ্য প্রদান করা জরুরি। ই-কোড মূলত  European Economic Community (EEC) ‘ইউরোপিয়ান ইকনোমিক কমিউনিটি’ কর্তৃক স্বীকৃত খাদ্য সংযোজন দ্রব্য বিশেষের (রাসায়নিক বা প্রাকৃতিক খাদ্যের অংশ, রং, স্বাদ বা রুচি বাড়ানোর উপাদান) নির্দেশিকা, যা নির্দিষ্ট কোড বা নম্বর দিয়ে আলাদা করা হয়েছে। অঞ্চলভিত্তিক ভাষার বিভিন্নতার দরুন প্যাকেটের গায়ে খাদ্যপণ্যের একটি নির্দিষ্ট নাম সব অঞ্চলের মানুষের জন্য অনুধাবন করা কষ্টসাধ্য। এ অবস্থায় ভাষার বিভিন্নতায় খাদ্য সংযোজনদ্রব্য বুঝতে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনকল্পে খাদ্য সংযোজন দ্রব্যগুলোকে, যা সাধারণত প্যাটেকজাত খাবারের মধ্যে অধিকাংশ সময় ব্যবহার করা হয়ে থাকে, নাম না লিখে ই-কোডের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। কেননা কোড বা নম্বর সব ভাষাভাষী মানুষই বুঝতে সক্ষম। প্রাথমিক পর্যায়ে ই-কোড নির্ধারণ করত  European Economic Community (EEC)। পরবর্তী সময়ে এর দায়িত্ব গ্রহণ করে  Codex Alimentarius Commission। তাই এটি হলো জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক গঠিত কোডেক্স এলিমেন্টারিয়াস কমিশন কর্তৃক খাদ্য, খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপদ খাদ্যবিষয়ক নির্ধারিত বা স্বীকৃত মান, ব্যবহারবিধি, নির্দেশনা এবং অন্য সুপারিশসংবলিত সমন্বিত খাদ্য কোড। বাংলাদেশেও  Codex Alimentarius Commission-এর ‘কোডনীতি’ অনুসরণ করা হয়। কাজেই প্যাকেটজাত খাদ্যপণ্যের গায়ে ই-কোড লেখার বিষয়টি বাংলাদেশেও স্বীকৃত। ই-কোড মৌলিকভাবে খাদ্য সংযোজন দ্রব্য বোঝায়। এখন জানতে হবে যে এ খাদ্য সংযোজন দ্রব্যগুলোর ‘উৎস’ কী? কেননা উৎস হালাল হলে সংশ্লিষ্ট সংযোজিত দ্রব্যও হালাল হবে, আর উৎস হারাম হলে সংযোজিত দ্রব্যও হারাম হবে। কাজেই ই-কোডের ভিত্তিতে খাদ্যপণ্যের হালাল ও হারাম নির্ধারণের জন্য ই-কোড নির্দেশিত উপাদানের উৎস সম্পর্কে জানা আবশ্যক।

ই-কোডের শ্রেণিবিভাগ

ই-কোডের খাদ্য উপকরণগুলো তিন ধরনের উৎস থেকে গ্রহণ করা হয়। যথা-

১. প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া। যেমন: গাছ, লতাপাতা, শস্য ইত্যাদি থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন উপাদান রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পৃথক করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে উপাদানগুলোর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী খাবারে ব্যবহার করা হয়।

২. রাসায়নিক উপায়ে প্রস্তুতকৃত। প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া ই-কোডগুলো অনেক সময় ব্যয়বহুল হওয়ায় পরবর্তী সময়ে কিছু রাসায়নিক উপাদান থেকে গ্রহণ করা হয়।

৩. প্রাণিজ উৎস থেকে পাওয়া। প্রাণিজ উৎস থেকে পাওয়া বিভিন্ন উপাদান রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পৃথক করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে উপাদানগুলোর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী খাবারে ব্যবহার করা হয়।

বলাবাহুল্য যেসব ই-কোডের উৎস প্রাকৃতিক কোনো উদ্ভিদ কিংবা রাসায়নিক কোনো হালাল পদার্থ, সেই ই-কোডগুলো তার উৎসর ভিত্তিতে ‘হালাল’ নির্দেশ করবে। কাজেই ব্যাপক অর্থে ‘সব ই-কোডই হারামের নির্দেশ করে’- এ দাবি বাস্তবতার আলোকে সঠিক নয়। উৎসর ভিত্তিতে হালাল ও হারামের নির্দেশক হওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত ই-কোডকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি-

১. হালাল যেসব ই-কোড নিশ্চিতভাবে উদ্ভিদ কিংবা রাসায়নিক হালাল বস্তু থেকে আহৃত উপাদানের নির্দেশ করে।

২. হারাম যেসব ই-কোড নিশ্চিতভাবে হারাম প্রাণিজ উৎস থেকে আহৃত উপাদানের নির্দেশ করে।

৩. মাশবুহ (যাতে হালাল-হারাম কোনোটাই স্পষ্ট নয়), যেসব ই-কোডের উপাদানের উৎস দ্বিমুখী সম্ভাবনা আছে যে তা উদ্ভিদ কিংবা রাসায়নিক হালাল বস্তু থেকে আহৃত হতে পারে, আবার প্রাণিজ উৎস থেকেও আহৃত হতে পারে। এ ই-কোডগুলো হালাল বা হারামের নির্দেশক হওয়ার ক্ষেত্রে অস্পষ্ট। আর খাদ্যপণ্যের মধ্যে যেহেতু গোশত ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে শরিয়তের মূল বিধান হলো হালাল হওয়া, কাজেই সে মূল হুকুমের ভিত্তিতে মাশবুহ ই-কোডযুক্ত খাবার খাওয়া জায়েজ হবে। তথাপি যেহেতু অস্পষ্টতা আছে, তাই তাকওয়া-পরহেজগারির দাবি ও উত্তম হলো পারতপক্ষে এ জাতীয় মাশবুহ ই-কোড থেকেও বেঁচে থাকা। এতদসত্ত্বেও কেউ যদি তা ক্রয় করে কিংবা খায়, তবে তা ক্রয় করা এবং খাওয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য বৈধ হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তা হারাম হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া না যায়।

সুতরাং মাশবুহ ই-কোডের হুকুম হলো গবেষণা এবং তথ্য অনুসন্ধানের মাধ্যমে এ অস্পষ্টতা দূরীকরণের চেষ্টা করতে হবে। অস্পষ্টতা দূর হয়ে গেলে সেটাকে হালাল বা হারামের নির্দেশক আখ্যা দেওয়া হবে। (দেখুন: বুখারি হাদিস: ৫২, রদ্দুল মুহতার: ১/১৫১)

হারাম ই-কোডের তালিকা
ই-কোডের তালিকা বেশ দীর্ঘ, যা প্রায় পাঁচ শর নিকটবর্তী। এর মধ্যে অধিকাংশ কোড হালাল নির্দেশক, আর বেশ কিছু রয়েছে মাশবুহ তথা সন্দেহযুক্ত, আর কিছু হারামও রয়েছে। তাই আমরা আন্তর্জাতিক মানের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান যথা: Sauth African national halal authority (SANHA), Halal foundation Pakistan, International halal certification (IHC) Pakistan-

সহ আরও কিছু গবেষণাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া তথ্য মতে সংক্ষিপ্তাকারে শুধু হারাম ই-কোডের তালিকা নিচে উল্লেখ করছি। হারাম ই-কোডগুলো (যা থেকে বেঁচে থাকা অপরিহার্য) নিম্নরূপ- E111, E120, E140, E141, E161b, E161g, E161i, E161j, E252, E428, E430, E431, E441, E485, E542, E630, E631, E632, E633, E634, E635, E640, E904, E920, E921, E951, E999, E1105, E1203, E1209, E1510, E1519

ওই তালিকা থেকে উপকৃত হওয়ার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত কয়েকটি বিষয় স্মরণে রাখতে হবে:

ক. হালাল খাদ্য বিষয়ক বিশ্বে একাধিক নির্ভরযোগ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোর গবেষণা ও সিদ্ধান্তে পরস্পরে কিছু পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে মতবিরোধপূর্ণ বিষয়গুলোতে সতর্কতার ওপর আমল করা উচিত।  

খ. উল্লিখিত হারাম ই-কোডগুলোর মধ্য থেকে কিছু ই-কোডের ব্যাপারে উৎসর ক্ষেত্রে নিজ নিজ গবেষণা অনুযায়ী কেউ কেউ মাশবুহর মত ব্যক্ত করেছেন। তাই সতর্কতামূলক হারাম হওয়ার মতটিই গ্রহণ করা হয়েছে।

গ. তালিকাভুক্ত কিছু কোডের ব্যাপারে উপাদান ও উৎসর পরিবর্তনের কারণে বিধানগত পরিবর্তন হতে পারে। (মাসিক আল-আবরার: অক্টোবর ২০২১ ইং)

বাংলাদেশ সময়: ০৮১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০২১
আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।