ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, প্রথম রক্ত দেয়া হয়েছিল ১৪৯২ সালে রোমের সপ্তম পোপের শরীরে। ধর্ম যে স্বাস্থ্য গবেষণায় বাধা হয় নি, তা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
১৯০১ সালে অস্ট্রিয়ান চিকিৎসা বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার রক্তের বিভিন্ন গ্রুপ আবিষ্কারের পর আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে রক্তদান শুরু হয়। তবে এর আগে রক্তদান পদ্ধতি নিরাপদ ছিল না। কারণ ভিন্ন গ্রুপের রক্ত শরীরে নিলে মৃত্যু হতে পারে, তখন পর্যন্ত বিষয়টি জানা ছিলনা। এতে করে প্রায়ই জীবনহানিসহ বিভিন্ন জটিল সমস্যা দেখা দিত।
কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার রক্তের গ্রুপ আবিষ্কারে প্রমাণ করেন যে, দাতা ও গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ একই না হলে গ্রহীতার মৃত্যু হতে পারে। এই আবিষ্কারের জন্য তিনি ১৯৩০ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
এরপরই শুরু হয় নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ওসহেলান্ড হোপ রবার্টসন নামে এক আর্মি অফিসার সর্বপ্রথম ব্লাড ব্যাংক প্রচলন করেন। এর ফলে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। ২০০৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৫৮তম অধিবেশনে কার্ল ল্যান্ডস্টেইনারের জন্মদিন ১৪ জুনকে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।
যারা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছেন তাদেরসহ সাধারণ জনগণকে রক্তদানে উৎসাহিত করাই এ দিবসের উদ্দেশ্য।
২০০০ সালে ‘নিরাপদ রক্ত’-এই থিম নিয়ে পালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৪ সালে প্রথম পালিত হয়েছিল বিশ্ব রক্তদান দিবস। ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিবেশনের পর থেকে প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ দিবস পালনের জন্য তাগিদ দিয়ে আসছে।
প্রতিবছর ৮ কোটি ইউনিট রক্ত স্বেচ্ছায় দান হয়, অথচ এর মাত্র ৩৮ শতাংশ সংগ্রহ হয় উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে, যেখানে বাস করে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ মানুষ। এ ছাড়া এখনো বিশ্বের অনেক দেশে মানুষের রক্তের চাহিদা হলে নির্ভর করতে হয় নিজের পরিবারের সদস্য বা নিজের বন্ধুদের রক্তদানের ওপর, আর অনেক দেশে পেশাদারি রক্তদাতা অর্থের বিনিময়ে রক্ত দান করে আসছে রোগীদের। অথচ বিশ্বের নানা দেশ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে জানা যায়, ‘নিরাপদ রক্ত সরবরাহের’ মূল ভিত্তি হলো স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে দান করা রক্ত। কারণ তাদের রক্ত তুলনামূলকভাবে নিরাপদ এবং এসব রক্তের মধ্য দিয়ে গ্রহীতার মধ্যে জীবনসংশয়ী সংক্রমণ, যেমন এইচআইভি ও হেপাটাইটিস সংক্রমণের আশঙ্কা খুবই কম।
বাংলাদেশে সামাজিক রক্তদানের হার খুব বেশি নয়। পারিবারিক প্রয়োজনে রক্ত দানের বাইরে কেউ স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে চান না। ব্লাড ব্যাংক থেকে কেনা রক্তের ঝুঁকির কথাও কারো অজানা নয়। পেশাদার রক্তদাতাদের শারীরিক সুস্থতাও সব সময় যাচাই করা সম্ভব হয় না। নেশাগ্রস্ত ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রক্ত বিক্রেতাদের সম্পর্কে প্রায়ই নানা আশংকাজনক খবর মিডিয়াতে দেখতে পাওয়া যায়। বিষয়টি ভয়েরও বটে।
কিন্তু বিপন্ন মানুষের জন্য যখন জীবন রক্ষার্থে জরুরি রক্তের প্রয়োজন হয়, তখন বাধ্য হয়েই বিপজ্জনক রক্ত নিতে হয়। তিরিশ বছর আগে আমার এক নিকটাত্মীয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রক্ত কিনে তার শরীরে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও কিছুদিন পর দেখা যায়, তিনি কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। বিপজ্জনক রক্ত নেওয়ায় তার রোগের সূচনা হয়েছিল এবং এক পর্যায়ে তিনি মারা যান। এমন করুণ অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে।
সামাজিক ও স্বেচ্ছায় রক্তদান এ ধরনের বিপদ থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, সুস্থ্য মানুষ রক্তদান করলে কোনও ক্ষতি হয় না। এজন্য অনেক মানবিক ও সমাজমনস্ক তরুণ-যুবক নিয়মিত রক্তদান করছেন। 'মানুষ মানুষের জন্য' কথাটি এখনো সার্থকতা পায় নিবেদিনপ্রাণ স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের কারণে।
আজকের এই দিনে স্বেচ্ছা রক্তদানের সামাজিক প্রণোদনা সৃজনের পাশাপাশি মানবতার স্বার্থে নিবেদিত রক্তদাতাদের প্রতি অন্তঃহীন শুভেচ্ছা জানানোও আমাদের কর্তব্য। নিঃস্বার্থ চিত্তে যারা প্রতিনিয়ত অজানা-অচেনা মানুষের সাথে নতুন করে 'রক্তের বন্ধন' রচনা করছেন, বিপন্ন মানুষকে সুস্থতার পথ দেখাচ্ছেন, তাদের প্রতি অভিনন্দন।
বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৭
জেডএম/