ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

টাকা নেই তো সেবাও নেই চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে!

রহমত উল্যাহ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৪
টাকা নেই তো সেবাও নেই চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সবকিছুতে অব্যবস্থাপনা লক্ষ করা গেছে।

বিনামূল্যে ওষুধ না দেওয়ার অভিযোগ ছাড়াও খাবারের নিম্নমান, পরিচ্ছন্নতার অভাব এবং পছন্দের দোকান থেকে ওষুধ কিনতে হয় রোগীদের।


 
নামে আধুনিক হলেও আবাসিক চিকিৎসক-নার্সদের অবহেলা ও চিকিৎসকদের মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভপ্রীতির কারণে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে।
 
রোগীরাদের অভিযোগ, দালাল যন্ত্রণা ছাড়াও টাকা না দিলে সেবা দিতে রাজি হয় না কর্মচারীরা। নার্স-কর্মচারীদের পছন্দের দোকান থেকে ওষুধ না কিনলে তা গ্রহণ করা হয় না।
 
হাসপাতালে সব রকমের সুযোগ-সুবিধা থাকলেও ঘাটতি রয়েছে নিম্নআয়ের রোগীর জন্য। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রোগী থাকলেও উচ্চ শ্রেণীর রোগী নেই বললেই চলে।
 
বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা সামছুল হক নামে এক রোগী বাংলানিউজকে অভিযোগ করেন, প্রায় দেড় বছর ধরে এখানে চিকিৎসা নিতে আসি। টিকিট ১০ টাকা হলেও এ নিয়ে আনসার, স্টাফ, নার্সরা বাণিজ্য করে।
 
এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা গেল, টিকিট কাউন্টার ২০ থেকে ২৫ জন ‘রেজিস্টার্ড দালাল’ (কর্মচারীদের সঙ্গে আঁতাত) নিয়ন্ত্রণ করে। অনেক সময় রোগীর দীর্ঘলাইন দেখা গেলেও তাদের বেশির ভাগই দালাল।
 
তারা ১০ টাকায় টিকেট কিনে ২০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি করে। প্রতিবাদ করলে স্টাফদের দিয়ে হয়রানি করা হয় বলে অভিযোগ করেন এক রোগী।  
 
টিকিট কিনে ও চিকিৎসা নিতে না পেরে রোগী সেলিম উদ্দিন নামে আরেক রোগী অভিযোগ করে বলেন, বহির্বিভাগের সামনে স্টাফ (১২৫-২৬নং রুম) টাকা না দিলে অনেক সময় হয়রানি করে।
 
রোগীদের অভিযোগ, প্রায় সময়ই চিকিৎসকেরা দেরি করে আসেন। আবার দুইটার আগে বের হয়ে যান। রোগী না থাকলে প্রাইভেট হাসপাতালে চলে যান। একই চিকিৎসক প্রাইভেট হাসপাতালের ঠিকানা দিয়ে দিয়ে সেখানে যেতে বলেন।
 
ওষুধের বিষয়ে অভিযোগ করে কয়েকজন রোগী বাংলানিউজকে বলেন, বহির্বিভাগ বলেন আর ভর্তি বলেন, টাকা ছাড়া কোনো ওষুধ দেওয়া হয় না। অথচ আপনাদের কাছে শুনি হাসপাতাল থেকে সব ওষুধ দেওয়া হয়।
 
পারভেজ নামে এক দালাল দম্ভ করে বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা স্থানীয় পোলাপাইন। হাসপাতালের কেউ আমাদের দিকে আঙুল তুলে কথা বলে চাকরি করতে পারবে না। ’

পরে তিনি ক্ষমতাসীন দলের একটি সংগঠনের নেতা বলে পরিচয় দেন।
 
রোগীরা অভিযোগ করেন, ২০ থেকে ২৫ জন দালালের কাছে বেড, টিকিট, ওষুধসহ বেশ কিছু সেবা জিম্মি হয়ে আছে।
 
চোখের ছানি অপারেশন করতে কুষ্টিয়া থেকে আসা আফজাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘তিনদিন আগে ভর্তি হলেও চিকিৎসক আসেননি। নার্সরা চিকিৎসা করাচ্ছে। কবে অপারেশন হবে তাও কিছু জানায়নি। ’
 
খাবার নিয়েও অভিযোগ করে তিনি বলেন, ১০ থেকে ১৫ টাকা হাতে ধরিয়ে দিলে ২/৩ জনের খাবার পাওয়া যায়। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নেই বললেই চলে। কর্মচারী ও নার্স টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না।
 
তিনি অভিযোগ করেন, আট দিন ঘুরে দালালের মাধ্যমে ঘুষ দিয়ে সিট নিয়েছি।

রোগীরা কর্মচারী ও নার্সদের কাছে জিম্মি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
 
পটুয়াখালী থেকে চোখের ছানি অপারেশন করতে আসা হাসপাতালে ভর্তি রোগী খোরশেদ আলম বাংলানিউজের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘চারদিন ঘুরে বখরা (ঘুষ) দিয়ে সিট পাইছি। ’
 
‘তিনদিন আগে অপারেশনের কথা থাকলেও টাকা দেইনি বলে অপারেশন হচ্ছে না’ অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘অপারেশনের সব ওষুধ হাসপাতালে থাকলেও আমার জন্য কেউ সুপারিশ করেনি বলে বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। ’
 
তিনি বলেন, নার্সের দেওয়া স্লিপে প্রায় আটশ টাকার ওষুধ কিনেছি। কোনো ডাক্তারই দেখতে আসে না।

‘কর্মচারী ও নার্সদের কাছে আমরা জিম্মি’ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
 
চারদিন ধরে পেয়িং বেডে অপারেশনের জন্য ভর্তি হওয়া রোগী মিনারা বেগম বলেন, বেডের নির্ধারিত ফিসের অনেক বেশি দিয়ে ভর্তি হয়েছি। প্রতিদিন কর্মচারী আর নার্সদের ২০ টাকার নিচে দিলে নিতে চায় না।
 
সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, কবে অপারেশন হবে তাও বলে না!
 
চতুর্থতলার একজন সিনিয়র নার্স নাম প্রকাশ না করায় শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, ড্রপ ছাড়া স্টোর থেকে আমাদের কোনো ওষুধ দেওয়া হয় না। ওষুধের সরবরাহ নেই বলে আমাদের জানানো হয়েছে।
 
বহির্বিভাগে এক্সরে, ইসিজিসহ বেশ কিছু পরীক্ষায় অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয় বলে সিরাজুল ইসলাম নামে এক বৃদ্ধ অভিযোগ করে বলেন, ইসিজি ৮০ টাকা হলেও অতিরিক্ত ১০/২০ টাকা না দিলে রিপোর্ট আসে না। কারো কাছে অভিযোগ করলে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়।
 
৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৫০ শয্যার দেশসেরা এ আধুনিক হাসপাতালটি নির্মিত হওয়ার পর ২০০৭ সালে চিকিৎসা সেবা শুরু হয়। জেলা শহরের চক্ষু রোগীদের অপারেশন ও উন্নত চিকিৎসার জন্য এ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
 
হাসপাতালে ক্যাটার‌্যাক্ট, কর্নিয়া, গ্লুকোমা, রেটিনা, অকুলোপাস্টিক, পেডিয়াট্রিক অপথোর্মোলজি, নিউরো অপথোর্মোলজি, কমিউনিটি অপথোর্মোলজি ও লোভিশন নামে নয়টি বিভাগ চালু রয়েছে।
 
সব বিভাগে রোগীদের সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অপারেশনের ব্যবস্থা থাকলেও তা সব সময় করা হয় না। প্রশিক্ষিত জনবল, আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রয়োজনীয় ওষুধ থাকলেও রোগীরা কাঙ্ক্ষিত সেবা পায় না।
 
১৩টি অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার থাকলেও চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির কারণে সবগুলোতে অপারেশন হয় না।
 
কিছু সমস্যা রয়েছে স্বীকার করে হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. হাসান ইমাম চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘রোগীদের অভিযোগ তাৎক্ষণিক নিরসনের চেষ্টা করা হচ্ছে। ’
 
পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধ সরবরাহ করা হয় বলে দাবি করেন তিনি।

‘দালাল, কর্মচারী-নার্সদের বিষয়ে আমরা পদক্ষেপ নেবো’ বলেও জানান তিনি।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।