ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

মনোকথা

দুর্যোগ ও মানুষ: বিভিন্ন শ্রেণির ওপর দুর্যোগের প্রভাব

ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৯ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৩
দুর্যোগ ও মানুষ: বিভিন্ন শ্রেণির ওপর দুর্যোগের প্রভাব

মানুষের মন এক অদ্ভুত বিষয়। সেই মন যে কখন কিভাবে কেন খারাপ হয়, কতটা খারাপ হয়, আর খারাপ হলেই বা তার প্রতিক্রিয়া কেমন হয় তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন।



শুধু দুর্যোগই নয়, যেকোনো ধরনের ঘটনায় বা ঘাত প্রতিঘাতে মনে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে। কম বেশি অতিরিক্ত কিংবা সম্পূর্ণ অকল্পনীয় প্রতিক্রিয়াও অনেক সময় পরিলক্ষিত হয়।

দুর্ঘটনায় বিভিন্ন দল বা গোষ্ঠীর ওপর প্রভাব:
ব্যক্তি বিশেষের মানসিক প্রতিক্রিয়ার বাইরে, বিভিন্ন গোষ্ঠী বা দলগত মানুষের ওপরও দুর্যোগের বিভিন্ন প্রভাব পড়ে। অবশ্য এসবের অনেক কিছুই নির্ভর করে, দুর্যোগ বা ঘটনাটি ঘটার পূর্বে সেই মানুষগুলোর অবস্থা কেমন থাকে তার ওপর। যেমন-
-    যেসব মানুষ আগে থেকেই চাপের মধ্যে থাকে।
-    যাদের দুর্যোগ মোকাবেলা করার মত যথেষ্ট লোকবল বা প্রযুক্তিগত সুবিধা থাকে না
-    পূর্ব থেকেই সঠিক ও প্রয়োজনীয় তথ্য থাকে না বা তথ্যগত দুর্বলতা থাকে।
-    যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা কিংবা যথাসময়ে প্রয়োজনীয় যোগাযোগের কমতি থাকা।
-    মোকাবেলা করার মতো প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব থাকে।

এসব ক্ষেত্রে দুর্যোগের বিরুপ প্রভাব বেশি হওয়া স্বাভাবিক।

একটি উদাহরণ টানা যায়, বৈশ্বিক অর্থনৈকিত মন্দার প্রভাব সবচেয়ে আগে পড়েছে তৃতীয় বিশ্বের নারীদের ওপর। তাদের কাজে, শ্রমে, অর্থ উপার্যনে, যাপিত জীবনে, এমনকি নিরাপত্তার ওপর। তাই হঠাৎ চলে আসা, দুর্যোগ বা দুর্ঘটনাও তাদের ওপর বেশি প্রভাব ফেলবে, এটা অনুমেয়।

গোষ্ঠীগত মানুষের যেসব দিকে নজর দেওয়া হবে, সেসব হচ্ছে- স্বাস্থ্য, আইনগত অধিকার, ক্ষতিপূরণ চাইবার বা পাওয়ার অধিকার, কাজ, সেই সঙ্গে মানসিক বিভিন্ন দিক। তবে একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সেই গ্রুপ বা গোষ্ঠীর ভেতরই সীমাবদ্ধ নয়। বরং বিভিন্ন গ্রুপেই দেখা যাবে কিছু কিছু সমস্যা একই রকম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই ব্যক্তি হয়তো ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর অর্ন্তভুক্তও হতে পারেন।
mono-12
শিশুর ওপর প্রভাব:
শিশুদের নিয়ে একটা ধারনা প্রচলিত আছে যে, তারা সবকিছুর সঙ্গেই সহজে মানিয়ে নিতে পারে এবং প্রয়োজনমতো দ্রুত পুষিয়ে নিতে পারে। এটি একটি ভুল ধারনা। কখনো কখনো বরং তাদের সমস্যা অন্যদের থেকে প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। মৃত্যু, ধ্বংস, নৃশংসতা, শারীরিক নির্যাতন এবং বাবা-মায়ের যেকোনো ধরনের অসহায়ত্ব শিশুদের সরাসরি আক্রান্ত করে। কাছের মানুষের প্রতিক্রিয়া তারা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করে। বাবা-মাও অনেক সময় শিশুদের প্রতিক্রিয়াগুলি সনাক্ত করতে ভুল করেন।

বাবা-মায়ের নিজস্ব সমস্যার কারণে শিশুদের চুপ থাকা বা বিভিন্ন অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াগুলিকে মনে হতে পারে শিশুদের ইচ্ছাকৃত কাজ। অনেক সময় বাবা-মা শিশুদের সমস্যাগুলোকে সমস্যা হিসেবে মানতেই চান না। অন্যদিকে শিশুও ভাবতে পারে যে, মা-বাবা বোধহয় তার দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন না। শিশু ভেতরে ভেতরে অসহায় বোধ করতে শুরু করে। তবে তারা যদি বাবা-মা বা বড়দের কাছ থেকে সহায়তা পায় বা নিশ্চয়তা পায় তবে খুব স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে।

এক থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের মাঝে সাধারণত বিভিন্ন রকমের এনজাইটি সিম্পটম দেখা যায়। তারা অনেকসময়ই বাবা-মা থেকে আলাদা হয়ে যাবার ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। আগন্তুক কিংবা জন্তু জানোয়ারের ভয়েও তারা ভীতু থাকে। এক্ষেত্রে ঘুমের সমস্যা একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। বড়দের মতো এরাও দুর্যোগ বা দুর্ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পরিস্থিতিকে পাশ কাটিয়ে চলতে চায়। তাদের দুর্যোগের বিষয়বস্তু নিয়ে খেলতেও দেখা যেতে পারে। অনেক সময় সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়। ছোট শিশুদের মাঝে পূর্বে শেখা সাধারণ সামাজিক নিয়ম কানুন ভুলে যেতেও দেখা যায়।

আর একটু বড় শিশু, যাদের বয়স ছয় থেকে এগারো, তাদের সব সময় নিরাপত্তার অভাবে ভুগতে দেখা যায়। তারা সাধারণত চারদিকের সবকিছু নিয়ে সব সময় ভয়ে থাকে। ঘুমের সমস্যা, খিটখিটে মেজাজ, যখন তখন রেগে যাওয়া প্রায়ই দেখা যায়। মা-বাবা বা আশপাশের মানুষের যেকোনো ধরনের অসহায়ত্বে তারা মনে সর্ব্বোচ্চ কষ্ট পেয়ে থাকে। একা একা দাড়িয়ে কাঁদতে থাকে। স্কুলে যাওয়াসহ অনেক সামাজিক কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কল্পনায় নিজস্ব জগত তৈরি করে, যারা তাদের অসহায়ত্ব থেকে বের করে আনবে।

বারো বছর বা তার বেশি বয়সের শিশুদের মাঝে প্রায় বড়দের মতো প্রতিক্রিয়াই দেখা যায়। সাধারণত নিয়মের ভেতর একেবারেই থাকতে চায়না। বিভিন্ন ধরনের অপরাধ, অনিয়ম উশৃঙ্খলাও তাদের মধ্যে প্রকট রূপ নেয়। এ ধরনের শিশুদের নিয়মের ভেতর আনাও অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। তাদের কাউন্সিলিং বাসানো সহজ হয়না। অনেক বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বড়দেও মতো পোস্ট ট্রমাটিক স্টেস ডিজঅর্ডারের সমস্যাও দেখা যায়।

এসব প্রতিক্রিয়ার অনেক কিছু বড় হলেও থেকে যেতে পারে। কোনো কিছুতেই আর কোনো কিছু করার নেই এমন প্রতিক্রিয়া মনের ভেতর বাসা বাধতে পারে।
mono-22
নারীর ওপর প্রভাব:
গরীব দেশগুলোর ক্ষতিয়ানে দেখা যায় দুর্যোগের প্রভাবে পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি নিহত হন। আবার ধনী দেশগুলোর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পুরুষদের চেয়ে নারীদেরই দুর্যোগ পরবর্তী মানসিক সমস্যাগুলো বেশি হয়। ডিপ্রেশান, পিটিএসডি বা এনাজাইটি জাতীয় সমস্যাগুলো তাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।

ওপরের তথ্যগুলো থেকে এটি বলা যায় যে, যেকোনো ক্ষেত্রেই নারীদের ওপর দুর্যোগের প্রভাব পুরুষের চেয়ে বেশি হয়। তাই সেসবকে ঠেকাতে বা কমাতে অবশ্যই বিশেষ এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

নারীদের ওপর বেশি প্রভাব পড়‍ার কারণ
আমরা জানি, নারীরা যদিও এখন আর শুধু ঘরে আবদ্ধ থাকে না তবুও সারা পৃথিবী জুড়েই তারা সাধারণত পরিবারের তদারকীর দায়িত্বেই থাকে। নারীরা মানসিক ভাবে প্রস্তুতই থাকে, যেন ঘর-শিশু-সম্পদ শেষ পর্যন্ত তাদেরই রক্ষা করতে হবে। তাই একধরনের দায়িত্ববোধ থেকেও দুর্যোগ মুহূর্তে তারা সব ছেড়ে সরে যেতে পারেন না। ফলে পরিবারের অন্য সদস্যের জন্যও তাকে অনেকসময় খারাপ পরিণতি ভোগ করতে হয়।

ঘরে থাকা বা অন্তর্গত পরিবেশে আবদ্ধ থাকার কারণে, ইনফরমেশনও তাদের কাছে কম পৌঁছায়। সুতুরাং দরকারে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিতেও সমস্যা হয়। শারীরিক সামর্থের বিষয়টিও কখনো কখনো চলে আসে।

দুর্যোগ পরবর্তী সমস্যাগুলোও নারীদের বেশি সহ্য করতে হয়। পারিবারিক নির্যাতন, মানসিক বা শারিরীক নির্যাতনও নারীদেরই বেশি সহ্য করতে হয়। যুদ্ধসহ বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে নারীরা বরং টার্গেটে পরিণত হয়। বিধবা বা ঘরভাঙা নারীদের ভোগান্তি আরো চরম হতে পারে। অধিকাংশ সময়ই তাদের পাশে কেউ থাকেনা, তারাও প্রয়োজনীয় কাজটি করতে পারেনা সময় মতো। পক্ষান্তরে যেসব নারীদের সামাজিক যোগাযোগ বেশি থাকে তারা বরং যেকোনো পুরুষের চেয়েও বেশি সহযোগীতা পেয়ে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পরিবার বা সামাজিক প্রথাকে মেনে নেওয়ার কারণেও তাদের বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়।
mono-32
বয়স্কদের ওপর প্রভাব:
চারদিকে বা খুব কাছে ঘটে যাওয়া বিপর্যয়ের ফলে, বয়োবৃদ্ধ মানুষগুলো মনের ওপর বয়ে যাওয়া ঝড়ের তেমন কোনো সর্বগ্রহনীয় তথ্য পাওয়া যায় না। একেক গবেষণায় একেক রকমের ফল দেখা গেছে, কেউ বলে- সাধারণ মানুষের যেমন প্রতিক্রিয়া বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে তার হেরফের নেই। কেউ আবার এ সত্য মানতে রাজি নয়। সবচেয়ে বড় যে সত্য বৃদ্ধরা বুঝে যায় তা হলো, এ বয়সে যা কিছু হারাব, হারাতে হবে, হারিয়ে যাবে বা হারিয়ে গেছে- তা আর পাবার নয়। আর সেসবকে ঠিক করার সময়ও হাতে নেই। তা সেসব মানুষই হোক, সম্পদই হোক!!

সমস্যা হয়, এবয়সের বোধগুলোকে সঠিকভাবে পরিমাপ করতে না পারার জন্য। অনেকেই মনে করেন বয়সের সাথে সাথে কিছু সমস্যা হবেই। এ ভাবনাটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বৃদ্ধ মানুষটির মানসিক অবস্থা বা সমস্যাকে সঠিক ভাবে নিরুপন করার পরিপন্থি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আসল সমস্যাগুলো চোখের আড়ালে থেকে যায়। দুর্যোগের পরপরও এমনটি হতে দেখা যায়। সবাই ভেবে নেন, এমনতো হতেই পারে।
 
আর এদিকে অন্ধকারেই থেকে যায়, বৃদ্ধ বয়সেই আকুতি আর আহাজারি। বয়সের অনেক গভীরে থেকে যায় দুঃখগুলো। শারীরিক অক্ষমতাও অনেক সময় এসবের ভেতর এসে চুপ করে ঢুকে যায়।
mono-420
প্রতিবন্ধীদের ওপর প্রভাব:
মানসিক, শারীরিক ও অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের ভিন্ন ধরনের চলার গতি ও চাহিদার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও দুর্যোগের প্রভাব এদের সবার ওপর প্রায় সমান ভাবেই পড়ে। তিন ধরনের মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

আমরা জানি জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের কাছের কেউ এসবে সাহায্য করেন। যখন এসবের ব্যত্যয় ঘটে তখন তারা ভীষণ মানসিক চাপের মধ্যে পড়েন।

আরেকটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন, স্বাভাবিক আর দশজন মানুষের মতো পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও অনেক ক্ষেত্রে এদের কম থাকে। তাদের সমস্যাগুলোকে অনেক সময় অবজ্ঞা করা হয়। খাওয়া দাওয়া থেকে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সব কিছুতেই তারা পিছিয়ে যায়। অনেকে ভেতরে ভেতরে বিষণ্নতায় ভুগতে থাকেন।
refugees-darfur
স্মরণার্থীদের ওপর প্রভাব:
আপাত দৃষ্টিতে দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষ ও স্মরণার্থীদের মাঝে পার্থক্য দেখলেও, বস্তুত দুক্ষেত্রেই মানসিক প্রভাব প্রায় একই রকম হয়ে থাকে। দু’ক্ষেত্রেই আক্রান্ত মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। দু’ক্ষেত্রেই অনেক কিছু হারিয়ে নতুন করে শুরু করতে হয়, নতুন করে শুরু করার প্রেরণা বা উৎস পর্যন্ত খুঁজে বেড়াতে হয়। নারী, শিশু, বৃদ্ধ, বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী কিংবা সরাসরি আক্রান্ত মানুষগুলোর অনুভূতি প্রায় একই রকম হয়।

স্মরণার্থী ক্যাম্পগুলোতেও বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন চলতে দেখা যায়। পিটিএসডি, ডিপ্রেশন এবং বিভিন্ন ধরনের এনজাইটি রিলেটেড সমস্যার প্রকোপ বেড়ে যায়। গোষ্ঠীগত মানুষ হিসেবে সব সময় একধরনের আতঙ্কের ভিতর দিয়েই সময় কাটাতে হয়। কখানে কখনো অনাকাঙ্খিত নির্যাতন, দুর্যোগের মতো ভয়াবহতা নিয়েই এসব মানুষের কাছে হাজির হয়। তাদেরও মৃত্যু কিংবা সম্পদ বিনাশের অবস্থাগুলোকে খুব কাছ থেকেই পর্যবেক্ষণ করতে হয় বা এসবের শিকার হতে হয়। ঘর-বড়ি বিনষ্ট হয় কিংবা ছেড়ে আসতে হয়। অন্যের ওপর অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করতে হয়। সামাজিক বন্ধন, নিয়মতান্ত্রিক জীবন ধারা, স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা ব্যবস্থা, অধিকার এমনকি ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার পরিবেশ নষ্ট হয়। দৈনন্দিন প্রায় প্রতিটি কাজই ব্যহত হয়। পরিবেশ, খাদ্য, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সবকিছু ভন্ডুল হয়ে যায়।
mono-520
উদ্ধারকর্মী, ত্রানকর্মীদের (সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও অন্যান্য সাহায্যকারী) ওপর প্রভাব:
উদ্ধারকর্মী ও ত্রানকর্মী হিসেব যারা কাজ করেন তারাও মানসিক বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে থাকেন। দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষের মতোই কিছু কিছু বিষয় তাদেরকেও সরাসরি প্রভাবিত করে। এমনকি কখনো কখনো তারা সরাসরিও আক্রান্ত হতে পারেন।

ঘটনা ঘটার পর থেকে তাদেরও বারবার অত্যন্ত সংবেদনশীল ও  মনোপীড়াদায়ক অবস্থার ভিতর দিয়েই যেতে হয়। শারীরিকভাবে বিষয়গুলোকে কখনো দুঃসহ কিংবা ক্লান্তিকর মনে হতে পারে। ঘুম, খাওয়া থেকে শুরু করে অনেক সময় সামান্যতম বিশ্রামের সময়ও বের করা কঠিন হয়ে যায়। দায়িত্ববোধ ও মানবতাবোধ অনেক সময় নিজেকে সরিয়ে নিতে নিজের ভেতর প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

অনেক সময় তীব্র যন্ত্রণাবোধ পেয়ে বসতে দেখা যায়, প্রয়োজনীয় সরবরাহ, সীমাবদ্ধতা, দক্ষতার কমতি থাকার কারণে। চোখের সামনে দেখা যায় কেউ একজন মরে যাচ্ছে কিছু কিছুই করার থাকে না দেখে। নিয়মতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক জটিলতাও অনেক সময় এসব কষ্টের ভিতর এসে যোগ দেয়। মানুষগুলো তখন নিজেদের আরো বেশি অপরাধী মনে করে। নিজেদেরই তখন তারা দায়ী ভাবতে শুরু করেন।

মানসিক প্রতিক্রিয়াগুলি সরাসরি আক্রান্ত মানুষের মতই হতে পারে। অনেকের ভেতর ধর্ম বিশ্বাস বা এমনকি নিয়মতান্ত্রিকতার ওপর বিরক্তি চলে আসতে পারে। সৃষ্টিকর্তা কিভাবে এটা ঘটতে দিলেন? কেন দিলেন? পিটিএসডি সহ বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় তারাও আক্রান্ত হতে পারেন।

যারা এধরনের কাজের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, যেমন- পুলিশ কিংবা ফায়ার ব্রিগেডের কর্মরত লোকজন, তাঁদের মাঝেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। কাজের ভিতরে থেকে সব কিছু সময় মতো করতে না পারা, কিংবা পূর্বের কোনো অভিজ্ঞতার কষ্ট নতুন করে ফিরে আসতেও দেখা যায়।

এছাড়া বিশেষ ধরনের আরো এক সমস্যাও এ দলের মানুষদের ভেতর দেখা যায়, যেসব পরবর্তীতে মানসিক যন্ত্রণা তৈরি করতে সহায়তা করে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজ, কাজের নিয়ম কিংবা পদ্ধতি নির্বাচনে নিজেদের ভেতর রেষারেষি এবং ভুল বুঝাবুঝি। কখানো কখনো বিভিন্ন এক্সপার্ট গ্রুপের কাজের পদ্ধতি নির্বাচন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে ঝামেলা হতে দেখা যায়। কাল ক্ষেপন কখনো আক্রান্ত মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যা পরবর্তীতে নিজেদের মনোপীড়ার কারণ হয়।

বিভিন্ন দলের ভেতর প্রতিক্রিয়ার ধরন এবং কারণ ভিন্ন হলেও প্রকাশ ভঙ্গী প্রায় একই রকম হয়। কখনো কখনো আক্রান্ত মানুষের চেয়েও ভয়বহ হতে দেখা যায়। যেমন- যে বৃদ্ধ লোকটি তার প্রাপ্ত বয়স্ত কোনো সন্তানকে হারায়, তার পরিবর্তন হয় চোখে পড়ার মতো। সে স্পষ্ট বুঝতে পারে, তার সন্তান লাভের আর কোনো আশা নেই। সে তখন নিজের জীবনের সব কিছুকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হিসেবে মূল্যায়ন করতে থাকে।

ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।