ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

মনোকথা

দুর্যোগ ও মানুষ: একটি গল্প

ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৪ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৩
দুর্যোগ ও মানুষ: একটি গল্প

গত ২৪ এপ্রিল সাভারের ভবন ধসের ঘটনাটির পর থেকে বিভিন্ন টেলিভিশন এবং প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে অনেক গল্প আমরা দেখেছি, শুনেছি, পড়েছি। ব্যক্তির গল্প, আহত মানুষের গল্প, মৃত মানুষটির গল্প, উদ্ধারকর্মীদের গল্প, বিল্ডিং ভাঙার গল্প, ভাঙা বিল্ডিং থেকে মানুষ উদ্ধারের গল্প।



দিনরাত খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে সারাক্ষণ কেউ কেউ চোখ রেখেছেন টিভির পর্দায়, আমিও। সকালে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে পেপারের সবগুলি পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে  দেখেছি নতুন কোনো আশার কথা আছে কিনা সেখানে। বুকের ভেতর ভীষণ ভার নিয়ে সারাদেশ থেকে ছুটে আসা স্বজনরা দাঁড়িয়ে থেকেছেন, কেঁদেছেন আর অপেক্ষা করেছেন কখন আসবে প্রিয় মানুষটি। বোনটি, ভাইটি, ছেলেটি, মেয়েটি, স্ত্রী কিংবা স্বামীটি।

কেউ পেয়েছেন, সত্যিই পেয়েছেন, সবাইকে অবাক করে দিয়ে আত্মার আত্মীয়কে জীবিত পেয়েছেন। চোখের কান্না, বুকের হাহাকার ফুৎকার দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন দূর আকাশে, জলের বান যেন ভেসে গেছে আলোর জোয়াড়ে।

জীবন নামক অদ্ভুত বিষয়টি আঁচ করেছে সারাদেশ, সারা পৃথিবীর মানুষ। জীবনের অর্থ বুঝি এমনি হয়। বেঁচে থাকার মানে বোধ হয় এতোই মধুর!

ঘটনার আটদিন পর, ৩ মে, শুক্রবার সন্ধ্যায় এমনি এক বেঁচে থাকা মানুষের সঙ্গে কথা হলো সরাসারি। বেঁচে থাকার পূর্ণ অর্থ তখনো তার চোখে-মুখে, কথার ভাষায়, গল্পে, সবখানে। দুই রাত আর আধাবেলা অন্ধকার কোটরে আটকে থাকার পর, নতুন এ জীবনের গল্প আবার শুরু। আহা!! জীবন। এর অর্থই বুঝি অন্যরকম, অন্যকিছু।

মেয়েটি কথা বলছিলো অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায়। কোনো ভয় নেই, টেনশন নেই। এতটুকু ক্লান্তি নেই তার গলায়, যেন সকালের ঘুম কেবল ভাঙল তার।

গল্পের শুরু করলো একেবারে শুরুর গল্প দিয়ে। অর্থাৎ ঘটনার সকালটা যেভাবে শুরু হলো তার সেখান থেকে। সাড়ে ৮টায় যখন উপরে উঠলো, কয়েকটা মেয়ে ছুটে এসে তাকে বললো- “আপা আজ কেন এসেছেন, একটু পরইতো ছুটি হয়ে যাবে। আপনি জানেন না। বিল্ডিংয়ের তিন তলায় ফাটল ধরেছে!” মেয়েটি তখন পাঁচ তলায়। কথা চলতে চলতেই হঠাৎ শুরু হলো ছুটাছুটি। মেয়েটি কোথাও যেতে পারলো না। দাঁড়িয়ে থাকলো। তার পাশে দাঁড়ানো আরো দুটি মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো।

অন্য দু’জন মেয়ের একজন নার্স, অন্যজন সাধারণ কর্মী। মেয়েটি নিজেও একজন নার্স। তার নিজের শিক্ষা কিংবা ইনটিউশনের বলে বুঝে নিল, এখন সিড়িতে যাওয়াও সম্ভব নয়। তাহলে হয়তো সিড়ির নীচেই চাপা পরে মরতে হবে। ভয় কিনা কে জানে, হয়তো মৃত্যুকে পরাহত করার উদ্দেশ্যে, তিনজন হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকলো। আর তখনই টের পেলো, তারা নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। বিল্ডিংটাই নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। তারপর আর কিছু মনে করতে পারলো না।

যখন টের পেলো, তখনই বুঝতে পারলো সে বেঁচেই আছে। বা হাতটা নাড়াতে পারছে না। টের পেলো বা হাতের উপর একটা পিলার পরে আছে। ডান হাতটা খালি। সে হাতে তখনো মোবাইলটা ধরে আছে, মোবাইলে সময় দেখলো। পরবর্তী সময়ে একইভাবে শুয়ে থেকে, বারবার মোবাইলে সময় দেখেছে, একদিন, দু’দিন কেটে যাচ্ছে। অন্ধকার, শব্দহীন। মোবাইলের ক্ষীণ আলোর মতো জীবনের আলোও নিভছে, জ্বলছে।

জ্ঞান ফিরে পাওয়ার কিছুক্ষণ পর মেয়েটি টের পেলো, তার কপাল দিয়ে রক্ত ঝরছে। নার্সিং পেশায় থাকার কারণে মনে ভয় ঢুকলো, এভাবে রক্তক্ষরণ হতে হতেই হয়তো মরে যাবে। কিন্তু এসসময় রক্তপাত এমনিতেই বন্ধ হয়ে গেলো।

নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যখন নিজেকে একটু সামলে নিলো, তখন মেয়েটি শব্দ করতে লাগলো, আশপাশের কেউ জীবিত থাকলে হয়তো শব্দ শুনতে পাবে। জবাবও পেলো একজনের। হাতধরা তিনজনের মধ্যে যে মেয়েটি সাধারণ কর্মী, সেই শব্দ করলো। “আপা আমিও জীবিত আছি, একটা পিলারের নীচে, কিন্তু নড়তে পারছিনা। ” সেখান থেকেই দুজনেরই বেঁচে থাকার নতুন গল্প শুরু হলো।

দু’জন কথা বলছে, দোয়া পড়ছে আর অপেক্ষা করছে। যদি কেউ আসে!!

মেয়েটি হিসাব করতে লাগলো। যেখানে আছি বা যেভাবে আছি, কেউ উদ্ধার করতে আসতেও বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে। সুতরাং অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। অপেক্ষা করতে লাগলো। দু’জন মাঝে মাঝে কথা বলা ছাড়া কি আর করবে! এরই মাঝে ঘটলো আরেকটি ঘটনা। ডান হাতটা একটু সরাতেই টের পেলো, রক্তে ভেজা একটা শরীর পাশেই পরে আছে। টের পেলো এটা শরীর নয়, শরীরের অংশ। অন্য নার্স মেয়েটির শরীরের খণ্ডিত অংশ। বাকি অংশ কোথায় ছিটকে পরেছে জানা নেই। রক্ত আর মাংসের গন্ধ নাকে আসছে। এক সময় সে অংশ থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতে লাগলো।

একদিন একরাত যাবার পর, দ্বিতীয় রাত নেমে আসছে। মেয়েটি নিজেই নিজের মৃত্যুর গন্ধ অনুভব করতে শুরু করলো। আর বোধ হয় বাঁচা হবেনা। কিন্তু দু’দিন পর সকালে উদ্ধার কর্মীরা পৌঁছে গেলো তার কাছে। দুপুরের দিকেই মেয়েটিকে এবং সন্ধ্যার পর অপর মেয়েটিকে জীবিত উদ্ধার করা হলো।

কিন্তু মেয়েটির বাম হাতটি, কনুয়ের উপর থেকে পিলারের নীচেই রয়ে গেলো।

গল্প বলতে বলতে মেয়েটির চোখ সত্যিই চক চক করছিলো। এম নিমিষেই যেন গল্প শেষ করলো। কোথাও আটকে যায়নি। আমিও তাকে বাধা দেইনি, শুনেছি। নিজে থেকেই বললো, “বিশ্বাস করেন স্যার, দু’দিনে একবারো ক্ষুধা লাগার কথা মনে হয়নি। এমনকি গলা পর্যন্ত শুকায়নি। ” অদ্ভুত! অদ্ভুত কথা!!

উপরের গল্পটি সত্যি গল্প, নিজে গিয়ে সাভার এনাম মেডিকেলের বিছানায় শুয়ে থাকা মেয়েটির গল্প শুনেছি। উদ্দেশ্য এমন ছিলো না। শুধু চেয়েছিলাম বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর মানসিক অবস্থা কি, একটু যদি বোঝা যেতো! হাসপাতালের একজন ডাক্তারের সহায়তায় এই গল্পটি শোনা হলো।

মেয়েটির বেঁচে থাকার ঘটনাটির বিশ্লেষণ কিছুটা এরকম-
মেয়েটির যখন নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে, সেটা তার মনে ছিলো, ঠিক তার পরের কথা সে মনে করতে পারেনি। হয়তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো, হয়তো নয়। বিজ্ঞান বলে, অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনার আকস্মিকতায় এমন হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ সেসব মনে করতে পারেনা। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে অনেক কিছুই মনে হতে থাকে। তবে ঘটনার ‘সিভিয়ারিটি’র ওপরও নির্ভর করে অনেক কিছু। এঘটনার ভয়বহতা সম্বন্ধে নিশ্চয়ই বর্ণনার কিছু নেই।

আমাদের শরীর এক অদ্ভূত যাদুর খেলা। কখন কোন কাজ করে, কিভাবে করে ভাবা যায় না।

বিজ্ঞান অনেক কিছু আবিষ্কার করেছে। আবার অনেক কিছু অন্ধকারেই রয়ে গেছে। আবিষ্কৃত একটু অংশ এখানে শেয়ার করতে চাই। মেয়েটি বলছিলো, ‘দুদিনে তার একবারও ক্ষুধা লাগেনি, এমন কি গলা পর্যন্ত শুকায়নি’- বিজ্ঞান বলে মানুষ যখন কোনো রকম ইমার্জেন্সি কন্ডিশনের পর (অতিরিক্ত চাপে থাকে) তখন নিজের ভেতরের সমস্ত মেকানিজম এলার্ট হয়ে আসে। নিজের ভিতরের এক সিস্টেম অন্য সিস্টেমগুলোকে সহায়তা করতে থাকে। মেয়েটির এমন অবস্থায় শরীরের ‘মেটাবলিজম’ নিশ্চিত প্রায় শূন্যের কোটায় চলে এসেছিলো। স্টেরয়েড সিক্রেশন হয়েছিলো প্রচুর পরিমানে। শরীরে জমে থাকা খাদ্য নিজস্ব পদ্ধতিতে কাজে লাগিয়েছে শরীর, তাই ক্ষুধা কিংবা পানির প্রয়োজন হয়নি।

যখন উদ্ধারকারীরা তাকে খুঁজে পেয়েছে, জীবনকে তিনি নতুন করে ফিরে পেয়েছেন। সে আনন্দে অন্য বেদনা কাজ করেনি তার। হাত না থাকা বা চোখের সামনে ঘটা এতো ঘটনা কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। সবকিছুর বিনিময়ে তার কাছে চলে এসেছে জীবন। অনেকে বেঁচে থাকার এ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াটিকে ‘হানিমুন স্টেজ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যার স্থায়িত্ব অনেক সময় নাও থাকতে পারে। মেয়েটির ক্ষেত্রে এটা ঘটে থাকতে পারে।

পরবর্তীতে থাকবে- দুর্যোগ ও মানুষ: বিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্লেষণ


ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪০ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।