ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

স্বাস্থ্যখাতে কথা রাখেনি সরকার

মাজেদুল নয়ন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০১৩
স্বাস্থ্যখাতে কথা রাখেনি সরকার

ঢাকা: দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা! নির্বাচনের আগে ঝুড়িভর্তি প্রতিশ্রতি দিলেও তার বাস্তব প্রতিফলন নগণ্যই দেখাতে পেরেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার।

জনগণের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন না হলেও পদোন্নতি আর সুযোগ গ্রহণে সরকার দলীয় চিকিৎসকদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে।

প্রতি অর্থবছরেই ধারাবাহিকভাবে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দও কমেছে। এরই মধ্যে সংসদে নিজ দলীয় সংসদ সদস্যদের ধারাবাহিক ধিক্কারে ‘ব্যর্থমন্ত্রী’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন ডা. আ ফ ম রুহুল হক।

সরকার দলীয় চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) চিকিৎসকদের নিয়োগ বাণিজ্য, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত ও পরে তা প্রত্যাহার, জয়পুরহাটের হতদরিদ্র মানুষের কিডনি বিক্রি, কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের অপরিকল্পিত ও দলীয় নিয়োগ, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) নির্বাচনে স্বাচিপের কারচুপির জয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর লাগামহীন ভর্তি ফি, গ্রামে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি, এ সবকিছুই স্বাস্থ্যখাতের সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাকে ভারী করেছে।  

জাতীয় বাজেটের আকৃতি বড় হলেও ২০১২-১৩ অর্থবছরের আগের মতো এবারও স্বাস্থ্যখাত অবহেলিত হয়েছে।

বাজেটে  স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা খাতে ৯ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা প্রস্তাবিত মোট বাজেটের ৪.৮৭ শতাংশ। এ বাজেট ২০১১-১২ অর্থবছরের চেয়ে দশমিক ২৩ শতাংশ কম।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ প্রতি অর্থবছরেই কমছে। গত ২০০৫-০৬ বছরে  স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ২০১১-১২ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে আরও কমে বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ১ শতাংশে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইস্তেহার অনুযায়ী পুনর্মূল্যায়ন করে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি তৈরি করতে সময় নেয় দীর্ঘ চার বছর।

নির্বাচনী ইস্তেহারে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের ক্ষমতাকালীন সময়ে নেওয়া পদক্ষেপের সূত্র ধরে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক চালুর প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত সরকারি হিসেবেই ১১ হাজার ২৬২টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে।

এর মধ্যে জানা গেছে, জমি সংক্রান্ত জটিলতার কারণেই বাকি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে না।

২০১১ সালের অক্টোবর মাসে ১৩ হাজার কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেয় সরকার। স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগে দলীয় প্রাধান্য স্বাস্থ্যখাতের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। যাচাই-বাছাই না করে নিয়োগ দেওয়াতে অনেকেই এখন অন্য চাকরিতে চলে গেছে।

শুধু কমিউনিটি ক্লিনিক নয়, চার বছরের স্বাস্থ্য সেক্টরের বিভিন্ন নিয়োগ এবং পদোন্নতিতে সরকার দলীয় চিকিৎসক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) দাপটে মূল্যায়িত হননি অনেক জ্যেষ্ঠ এবং মেধাবী চিকিৎসকরা।

স্বাস্থ্যখাতের নিয়োগ নিয়ে স্বাচিপের জোর জবরদস্তি ছিল সমালোচনার অন্যতম জায়গা।

আওয়ামী সরকারের বিভিন্ন সময়ে ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন কমিটির (ডিপিসি) মাধ্যমে সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপক পদের শিক্ষক চিকিৎসকদের পদোন্নতির এ ফলাফলে দেখা যায় সরকার দলীয় চিকিৎসক সংগঠন স্বাচিপের নেতা-কর্মীদের দাপট।

সর্বশেষ চলতি এপ্রিলে দলীয় ভিত্তিতে দেড় হাজার চিকিৎসকের নিয়োগ সমালোচনায় ফেলেছে সরকারকে।

শুধু নিয়োগ বা পদোন্নতি নয়, স্বাস্থ্যখাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) নির্বাচনে কারচুপি আশ্রয় নিয়ে  স্বাচিপের প্রার্থী মাহমুদুল হাসান সভাপতি ও ইকবাল আর্সনাল মহাসচিব নির্বাচিত হন। চিকিৎসকদের নির্বাচনে এ ধরনের কারচুপি হতাশ করে দেশের মানুষকে।

নির্বাচনী ইস্তেহারে পুষ্টি, শিশু ও মাতৃমঙ্গল নিশ্চিত করার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, সে ক্ষেত্রেও খুব বেশি সফলতা আসেনি বর্তমান সরকারের।

সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও গত দু’দশকে পুষ্টির অভাবে শিশুমৃত্যু হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তবে দেশে প্রসবকালীন মা ও শিশু মৃত্যুর হার এখনও উদ্বেগজনক। এর অন্যতম কারণ মাত্র ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ গর্ভবতী মা প্রসবের সময় চিকিৎসক, সেবিকা অথবা প্রশিক্ষিত ধাত্রীর সহযোগিতা পেয়ে থাকেন।

অবশ্য চার বছরে স্বাস্থ্যখাতে সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্যের মধ্যে রয়েছে মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ। এর ফলে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু কমে আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

২০১১ সালের শুরুতেই ১১ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়। এর ফলে সরকারি চাকরিতে কর্মরত নারীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস ভোগ করছেন। আগে তারা ছুটি পেতেন চার মাস।

আর্সেনিক সমস্যা সমাধান করে ২০১১ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ সুপেয় পানি এবং ২০১৩ সালের মধ্যে প্রতি বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা হবে বলে ইস্তেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ।

বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে স্যানিটেশন স্থাপনের কাজও বেশি দূর আগায়নি।

নির্বাচনী ইস্তেহারে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন ও রফতানি বৃদ্ধির লক্ষে ওষুধনীতি যুগোপযোগী করা হবে। হোমিওপ্যাথি, ইউনানি ও আয়ুর্বেদসহ দেশজ চিকিৎসা শিক্ষা এবং ভেষজ ওষুধের মানোন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অথচ চার বছর চলে গেলেও ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতির এখনো কোনো সংস্কারের নাম-গন্ধ নেই। ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণ, ভেজাল ও নকল ওষুধ উৎপাদনকারীদের শাস্তি, ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে যথাযথ অবদান রাখতে পারছে না এই নীতি।

এছাড়াও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার উন্নয়নেও তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি মন্ত্রণালয়। ফলে, দেশের ২৫৮টি ওষুধ কোম্পানির মধ্যে মাত্র ৪০টির ওষুধ মানসম্মত হলেও বাকি অধিকাংশ ওষুধেরই মান নিয়ন্ত্রণ করা হয় না।

এ সুযোগে জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দফায় দফায় মূল্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে নিয়মিত বিরতিতেই।

মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতায় রীতিমতো হতবাক সংসদীয় কমিটি।

২০১২ সালের ১১ অক্টোবর কমিটির ২৯তম সভায় সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, “স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যা ইচ্ছা, তাই করছে। কোনো নিয়ম-নীতি মানছে না। ”

চিকিৎসকের অভাব, কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার অভিযোগে বিভিন্ন সময় সংসদে দলীয় এমপিদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হককে।

এর মধ্যে ২০১২ সালের ৩ জুলাই সংসদে ভুল চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত চিকিৎসকদের পক্ষে মন্তব্য করতে গিয়ে এমপিদের তীব্র ক্ষোভের মুখে পড়েন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

৭ ফেব্রুয়ারি নিজেদের নির্বাচনী এলাকার হাসপাতালের বেহাল দশা বর্ণনা করে কয়েকজন এমপি বলেন, এসব নিয়ে প্রশ্ন করে মন্ত্রীকে লজ্জা দিতে চাই না। কারণ, এখন লজ্জাতে প্রিজারভেটিভ দেওয়া থাকে।

সর্বশেষ ২২ নভেম্বরও একই অভিযোগে সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে পড়ে স্বাস্থ্যখাতের বেহাল-দশার কথা স্বীকার করে করণীয় সর্ম্পকে সবার পরামর্শ চান রুহুল হক।

নির্বাচনী ইস্তেহারে জনগণের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও সারাদেশে এখনও ৫৭৩১ জন চিকিৎসক ও তিন হাজারের বেশি নার্সের পদ শূন্য রয়েছে বলে এদিন সংসদে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

এরই সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, চিকিৎসক, সেবিকা, স্বাস্থ্যকর্মীসহ স্বাস্থ্যখাতে ৫৯ হাজার পদে নিয়োগ দিয়েছে সরকার।

দেশে ভাইরাসজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে এ কয়েক বছরে। ২০১০ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবর ও ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অ্যানথ্রাক্স ও নিপাহ ভাইরাসের প্রার্দুভাব দেখা যায়।

এ ছাড়াও ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় বার্ড ফ্লুতেও আক্রান্ত হয় এক ব্যক্তি। নিপাহ ভাইরাসে ২০১৩ সালেও মৃতের সংখ্যা ছিল ১৫ জন।   কিন্তু এসব রোগের মৌসুমের আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের কোনো ধরনের জনসচেতনতামূলক প্রচারণা দেখা যায়নি।

২০১২ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত করে পরীক্ষার মাত্র দুই মাস আগে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে। আদালত ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আবারও ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্তে ফিরে আসে সরকার।

২০১২ সালের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগায়নি সরকার। ২০১৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের এখনও ঘোষণা দেওয়া হয়নি কী প্রক্রিয়ায় হবে মেডিকেলে ভর্তি।

তবে ২০১১ সাল থেকে নতুন কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে এবং কয়েকটিতে আসন বৃদ্ধি করা হয়েছে।

বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোর ভর্তি ফি ও টিউশন ফি নিয়ন্ত্রণ ও মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেয়। নতুন করে রাজধানীতে আরও ৭টি এবং ঢাকার বাইরে আরও ৪টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপনে নীতিগত অনুমোদন প্রদান করেছে সরকার। ৭টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের অনুমোদন দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

আওয়ামী সরকারের ৪ বছরে স্বাস্থ্যখাতে সবচেয়ে ট্রাজিক ঘটনার মধ্যে রয়েছে ২০১১ সালের আগস্টে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার ১৮টি গ্রামে হতদরিদ্র মানুষের কিডনি বিক্রির ট্রাজেডি। এ ঘটনার ফলাফলে দেশে এখনও কিডনি প্রতিস্থাপন স্বাভাবিক হয়নি।

এছাড়াও ২০১১ সালের জুন মাসে বেসরকারি ডাক্তারদের চিকিৎসা ফি ও প্যাথলজি পরীক্ষার চার্জের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু হলেও সেটি এখনও অন্ধকারে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০৭ ঘণ্টা, এপ্রিল  ০৭, ২০১৩
এমএন/সম্পাদনা: আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।