ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

কুষ্টিয়া হাসপাতালের চিকিৎসকরাই জেলার ক্লিনিকগুলোর দায়িত্বে

শরীফ বিশ্বাস, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১২
কুষ্টিয়া হাসপাতালের চিকিৎসকরাই জেলার ক্লিনিকগুলোর দায়িত্বে

কুষ্টিয়া: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স আর ওষুধ সংকটে মুখ থুবড়ে পড়েছে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা। আবার যেসব চিকিৎসক এখানে রয়েছেন তাদের মনোযোগ বেসরকারি ক্লিনিকের দিকে।

ফলে কুষ্টিয়া ছাড়াও আশপাশের কয়েকটি জেলা থেকে প্রতিদিন শত শত রোগী উন্নত চিকিৎসার আশায় এ হাসপাতালে আসলেও তারা ঠিকমতো সেবা পাচ্ছেন না।

বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ১৯৬৩ সালে ১শ শয্যা নিয়ে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘ ৪৬ বছর পর ২০০৫ সালে হাসপাতালটি ২৫০ শয্যার আধুনিক হাসপাতালে উন্নীত করা হয়। এতে বৃহত্তর কুষ্টিয়াসহ আশপাশের জেলার মানুষ ভেবেছিলেন উন্নত চিকিৎসার জন্য আর তাদের ঢাকায় ছুটতে হবে না। কিন্তু এ উন্নয়ন শুধমাত্র কিছু সুদৃশ্য ভবন আর সাইনবোর্ড স্থাপনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে এখন। আগের সেই লোকবল দিয়ে কোনো রকমে চলছে এর কার্যক্রম।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২৫০ শয্যার হাসপাতালে বিশেষজ্ঞসহ চিকিৎসকের পদ রয়েছে ৭০টি, কিন্তু এ হাসপাতালে আছেন চিকিৎসক মাত্র ৫০ জন। এছাড়াও কাগজের অভাবে ইসিজি মেশিন বন্ধ, জ্বালানির অভাবে জেনারেটর চলে না। আর সেই সঙ্গে রয়েছে ডাক্তারদের দৌরাত্ম্য। একটু জটিল রোগ হলেই তারা রোগীদের পাঠিয়ে দেন শহরের কেনো ক্লিনিকে কিংবা ঢাকা ও রাজশাহী মেডিকেলে। ক্লিনিকের চিকিৎসকরাই হলেন আবার সরকারি হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসকরাই। এর প্রতিবাদ করলেই রোগীদের কপালে জোটে গাল-মন্দ।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলার জুগিয়া পালপাড়ার ব্যবসায়ী ইয়ার আলী বাংলানিউজকে জানান, কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল নামেই আড়াইশ শয্যার। এখানে রোগীদের সেবা পাওয়া ভার। একটু জটিল রোগী হাসপাতালে গেলেই দায় এড়াতে মুহুর্তের মধ্যেই রেফার্ড করেন ঢাকা কিংবা রাজশাহীতে। তাহলে আমাদের আড়াইশ’ বেড থেকে কি লাভ।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হররা গ্রামের আমিরুল ইসলাম জানান, তার শিশুকে ভর্তি করেছেন এ হাসপাতালে। ঠান্ডাজনিত কারণে তাকে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল থেকে কোনো ওষুধ দেওয়া হয়নি তাকে। শুনেছি হাসপাতাল থেকে অনেক কিছুই দেওয়া হয়। কিন্তু কই কিছুই তো দেওয়া হয়নি। ক্যানালগ পর্যন্ত কিনতে হয়েছে বাইরে থেকে। আমাদের মতো মানুষ হাসপাতালে আসে কম খরচে ভালো চিকিৎসা পাওয়ার আসায়। কিন্তু সব কিছুই যদি বাইরে থেকে কেনা লাগে তাহলে কি করে বাঁচবো।

আমিরুলের মতো গোবরা চাঁদপুর থেকে আসা আব্দুস ছাত্তার (৭০) ভর্তি হয়েছেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। তিনি জানান, সকালে একবার চিকিৎসক এসে দায়সারাভাবে দেখে গেলেও সারা দিনে কোনো খোঁজ নেই। আবার নার্সদের সেবা মেলা ভার।
 
কুমারখালীর বাটিকামারা থেকে ডায়রিয়াজনিত রোগে ভর্তি হয়েছেন, মোফাজ্জেল হোসেন (৬০)। পেটে অনেক ব্যথা। হাসপাতাল থেকে তাকে মাত্র দু’টি বড়ি দেওয়া হয়েছে। স্যালাইন দেয়নি। এমন চিত্র গোটা হাসপাতাল জুড়ে।

আউটডোরের অবস্থা আরও ভয়াবহ। চিকিৎসকরা আসেন দেরিতে। ৯টায় স্ব স্ব বিভাগে চিকিৎসক আসার কথা থাকলেও আসেন ১০টায়। কখনও কখনও আরও দেরিতে। অথচ সকাল ৭টা থেকেই রোগীরা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন বারান্দায়। আউটডোরের টিকিট কেটে চিকিৎসকের অপেক্ষায়। এমন অপেক্ষা ছুটির দিন ব্যতিত সব দিনই।  

তবে চিকিৎসায় হাসপাতালের ডাক্তারদের অনীহার কথা স্বীকার না করলেও প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে রোগীদের ভোগান্তির কথা অকপটে কবুল করেছেন সেখানকার কর্মকর্তারা।
 
হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) তাপস কুমার পাল জানালেন, আড়াইশ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। তাছাড়া নার্স ও কর্মচারীরও সংকট রয়েছে। চিকিৎসক সংকটের কারণে চিকিৎসা সেবা মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। ৭০ জন চিকিৎসকের স্থলে রয়েছে মাত্র ৫০ জন। এছাড়া হাসপাতালে ১২০ জন নার্সের স্থলে রয়েছে ৭৩ জন। চিকিৎসক ও নার্স সংকট নিরসনে সংশ্লিষ্ট দফতরে একাধিকবার অবহিত করা হয়েছে। তারা সংকট দুরিকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে আশ্বাস দিয়েছেন।

তিনি জানান, বৃহত্তর কুষ্টিয়ার প্রায় ৩শ থেকে ৪শ রোগী প্রতিদিন হাসপাতালে আসেন চিকিৎসা নিতে। চিকিৎসক সংকটের কারণে তাদের সেবা শতভাগ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা।
 
আরএমও আরও জানান, সত্যি কথা বলতে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল আড়াইশ শয্যার হলেও এখানে অনেক সেবায় নেই। বিশেষ করে এমআরআই, সিটি স্ক্যানসহ উন্নত রক্ত পরীক্ষার সুযোগ নেই এখানে। জরুরি ভিত্তিতে এসব ব্যবস্থার প্রয়োজন বলে তিনি দাবি করেন।

হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ম, ওষুধ প্রদানে অনিয়ম আর বিভিন্ন ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে প্রসঙ্গে আরএমও তাপস কুমার পাল জানান, দালালদের দৌরাত্ম রয়েছে। তবে আগের মতো নয়। যারা রয়েছেন তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

তাছাড়া হাসপাতালে ওষুধ প্রদানে অনিয়ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যে সব ওষুধ বরাদ্দ রয়েছে তা রোগীদের সরবরাহ করা হয়। এক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম নেই। ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের জন্য সপ্তাহে দু’দিন সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবেন। সেই ক্ষেত্রে অবশ্যই রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের পর। ”
 
এদিকে, দীর্ঘদিন ধরে বিকল হওয়া হাসপাতালের দু’টি এ্যাম্বুলেন্স আজও সচল হয়নি। ফলে হাসপাতাল থেকে রোগীদের ঢাকায় কিংবা রাজশাহীতে নিতে হলে বাইরে থেকে ভাড়া করা হয় এ্যাম্বুলেন্স।
 
এছাড়া হাসপাতালে বিদ্যুতের সমস্যাও রয়েছে। বিদ্যুতের লোডশেডিং হলে শুধুমাত্র অপারেশন থিয়েটারের জন্য জেনারেটরের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যদিও তেলের অভাবে জেনারেটরও চালানো হয়না। এতে অপারেশন থিয়েটারে রোগীদের কি অবস্থা হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

তবে হাসপাতালে শতভাগ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হলে জরুরিভাবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, মেডিকেল অফিসার, নার্স নিয়োগ দেওয়ার দাবি কুষ্টিয়াবাসীর। কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হলেই এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন জেলাবাসী।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১২
সম্পাদনা: মাহাবুর আলম সোহাগ, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।