ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ফ্রান্স

৭১ এর নৌকমান্ডো এনামুল হক

আমাদের কথা কেউ বলে না!

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩, ২০১৬
আমাদের কথা কেউ বলে না! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

প্যারিস: বয়স তখন মাত্র ১৮। ঢাকার জগন্নাথ কলেজের ছাত্র।

এরইমধ্যে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ২৫ মার্চ রাতের নারকীয় হত্যাকাণ্ড দেখেছেন কাছ থেকে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে গিয়েছিলেন নরসিংদী জেলার রায়পুরে নিজের গ্রামে।

কিন্তু তাতেও মনে শান্তি পাননি। পাননি বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। তাই বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পালিয়ে যান ভারতের আগরতলার মতিনগরে। সেখান থেকে ভারতের  বিভিন্ন স্থানে। এভাবেই এক সময় সদস্য হয়ে ওঠেন মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সুইসাইড স্কোয়াডে। পরে এই স্কোয়াড রূপ নেয় প্রথম নৌকমান্ডোতে। তিনি সেই কমান্ডের অন্যতম সদস্য এনামুল হক। বুকে মাইন বেঁধে অংশ নিয়েছিলেন অপারেশন জ্যাকপটে।

৩০ বছর হলো তিনি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে আছেন। প্যারিস প্রবাসী মাইম মাস্টার পার্থ প্রতীম মজুমদারের বাড়িতে দেখা এই বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। আগের দিনই পার্থদা ফোন করে বলেছিলেন, সারপ্রাইজ আছে, যেনো ১১টার মধ্যে যেনো তার বাড়িতে যাই।

এনামুল হক বলে চলেন তার যুদ্ধে যাওয়ার গল্প।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের যে দলটি নিজেদের মৃত্যু সনদে নিজেরা স্বাক্ষর করে মরণ খেলায় মেতে উঠেছিল, অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের মতো তাদের কথা কেউ ফলাও করে বলে না। অন্যদেশের লেখকদের কাছে তাদের বীরত্বের কথা গুরুত্ব পেলেও বাংলাদেশে তেমনটা চোখে পড়ে না। আমাদের নৌকমান্ডের সুইসাইডাল স্কোয়াডের ৭১’র ১৫ আগস্টের অপারেশন (অপারেশন জ্যাকপট) সারা দেশে পাকিস্তানি বাহিনীকে থমকে যেতে বাধ্য করেছিল।

তিনি বলেন, এরপর পাকিস্তানি বাহিনীর তাণ্ডব স্তব্ধ হতে শুরু করে, বন্ধ হয়ে যায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জলসীমায় যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং খাদ্য সরবরাহ লাইন। আমাদের এই নৌকম‍ান্ডোকে তখন ভারতীয় অফিসাররা আদর করে ডাকতেন ‘ফ্রগম্যান’। ১০ নম্বর সেক্টরের অধীন নৌকমান্ডের কোনো সেক্টর কমান্ডার ছিল না। আমাদের পরিচালনা করতেন সেনা প্রধান এম এ জি ওসমানী। ৪১৫ সদস্যের এই স্কোয়াডের প্রশিক্ষক ছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার জি. মার্টিস, লে. এস কে দাস এবং লে. কপিল।

ভারতীয় প্রশিক্ষকদের মধ্যে একমাত্র বাঙ‍ালি অফিসার ছিলেন লে. সমীর কুমার দাস। আমাদের মতো বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদের দেখে তার মায়া হলো। আমাদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, তাহলো আমরা সাঁতরে গিয়ে জাহাজে মাইন ফিট করবো। প্রতিটি জাহাজে তিনটা করে। এতে মাইন বিস্ফোরণে জাহাজ ডুববে এবং আমরাও নিশ্চিত মৃত্যুবরণ করবো। দাস বাবু আমাদের বাঁচানোর উপায় খুঁজতে থাকেন। তিনি ‘লিমপেট’ মাইনের বদলে অল্প খরচে একই কার্যকারিতার নতুন মাইন আবিষ্কার করলেন। নতুন মাইনে একটি ঘড়ি লাগিয়ে দিলেন। ৪০ মিনিটের মধ্যে পালিয়ে আসতে পারলে বেঁচে যাবো এই নিশ্চয়তা দিয়ে আমাদের মনোবল আরো বাড়িযে দিলেন। আমরা তার নামে এই মাইনের নাম দিয়েছিলাম ‘দাস মাইন’। এতে আমাদের ৮০ ভাগ কামান্ডোই জীবন নিয়ে ফিরে আসতে সক্ষম হন।
parish_01
অপারেশন জ্যাকপট সম্পর্কে এনামুল হক বলেন, প্রশিক্ষণ শেষে ৩১০ জন নৌকমান্ডো থেকে  বাছাই করে ১৬০ জনকে ২ থেকে ৬ আগস্টের মধ্যে বাংলাদেশের চারটি বন্দরে পাঠানো হয়। ১৪ আগস্ট আকাশবাণীর ‘খ’ কেন্দ্র থেকে সকাল সাড়ে সাতটায় পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া ‘আমি তোমায় যতো শুনিয়েছিলাম গান’ বাজানোর মাধ্যমে আক্রমণে প্রস্তুতি সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণের নির্দেশ থাকলেও পরবর্তী গান আর বাজেনি। আমরা প্রস্তুতি নিয়ে সংকেতের অপেক্ষায় থাকি। পরে জানতে পেরেছিলাম, পাকিস্তান বাহিনীকে ধোঁকা দিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। পরে ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে বেজে ওঠে ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ি’ গানটি। আমরা একই সাথে দেশের চার নৌবন্দরে চট্টগ্রাম, মংলা, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরে একই সময়ে হামলা চালাই।

তিনি বলেন, আমাদের এই অপারেশনে নৌবন্দরগুলো কেঁপে উঠেছিল। কমান্ডোদের ফিট করা মাইনের বিস্ফোরণে দখলদার বাহিনী দিগ্বিদিক হারিয়ে ফেলে। বাণিজ্যিক জাহাজগুলো থেকে ‘এসওএস’ বার্তা যেতে থাকে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের পণ্য ও সমরাস্ত্র নিয়ে জাহাজগুলো পানির নীচে তলিয়ে যায়। সারা বিশ্বে আতংক ছড়ায় ‘অপারেশন জ্যাকপট’। চূড়ান্ত বিজয়ের আগ পর্যন্ত এই নৌকমান্ডো দল ১৫০টি অভিযান চালায়, শত্রুবাহিনীর ৭৫ হাজার মেট্রিকটন সামগ্রী ও অস্ত্র নষ্ট করে দেয়। এক লাখ টন যুদ্ধাস্ত্র প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। এটা নয় মাসের যুদ্ধে হানাদারদের ব্যবহৃত অস্ত্রের প্রায় অর্ধেক।

এনামূল হক তার প্রবাস জীবন সম্পর্কে বলেন, প্রবাস আমার নীরব কান্নার নাম। আমার দেহ এখানে পড়ে থাকে, হৃদয় বাংলাদেশে। দেশের জন্য আমরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলাম। আমরা দেশ ছাড়তে চাইনি। আমাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। এজন্য সব পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছিল। ৭৫’ পরবর্তী সময়ে দেশে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলার সাহসও হারিয়ে ফেলেছিলাম।

১৯ বছর বয়সে দেশ স্বাধীন করে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূ-গোলে পাশ করে জার্মানিতে চলে আসি প্রিন্টিং টেকনোলজি পড়তে। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে তা শেষ না করেই আইটিটি কোম্পানিতে জয়েন করি টিভি টিউব এর কালার কম্পোজিটার হিসেবে। ১৯৮১ সালে স্থায়ীভাবে চলে আসি প্যারিসে। ১৯৮৮ সালে ঢাকা সিটির ট্রান্সপোর্ট ম্যানেজমেন্টের ওপর বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের বিউবি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শুরু করি। এর আগে ১৯৭৮ সালে ঢাকার বাংলা একাডেমীতে যোগ দিয়েছিলাম ফোকলোর পরিষদে। আমার স্ত্রী নিশাত ফাতিমা এক সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে খবর পড়তেন। আমরা এখন ফরাসী নাগরিক। স্ত্রী একটি হাসপাতালে চাকরি করেন। আমি একটি অর্গানিক এগ্রোফার্মে কাজ করি। মেয়ে মৌরুসী তাসমিয়া লাইভ সায়েন্সে মাস্টার্স করছে, আর ছেলে বায়েজিদুল বিটিএস পড়ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩, ২০১৫
আরএম/জেডএম

** ট্যাক্সি চালক থেকে মেয়র প্রার্থী
** হাঁটা পথে ইউরোপে
** প্যালেস ডি সালভাদর দালি
** প্যা‌রিসে ম‌লিন আবহে বড়‌দিন
** গির্জাভিত্তিক পর্যটন
** এনভার্সে জাকিরের দেখা
** বাস্তিল ঘিরে পর্যটন
** প্যারিসের গণতন্ত্র ময়দান
** বাতাক্লঁয়ে প্রতিদিনই আসছে মানুষ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।