ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ফ্রান্স

প্যারিস থেকে রহমান মাসুদ

হাঁটা পথে ইউরোপে

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৫
হাঁটা পথে ইউরোপে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

প্যারিস: ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের এক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে কাজ করেন লিটন। বাড়ি খুলনা জেলায়।

এক সময় ছাত্র রাজনীতিতে নাম ছিল তার। এখন বাংলাদেশি মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টের সেকেন্ড শেফ।

১০ বছরের প্রবাস জীবনে একবারও দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়নি লিটনের। কোলের যে মেয়েটিকে রেখে এসেছিলেন বাংলাদেশে, তার বয়স এখন ১১ বছর। মেয়েকে দেখতে সব সময় মন কেমন কেমন করে তার। কিন্তু এখনো বৈধতার কাগজ পাননি। অবৈধ অভিবাসী হয়ে যাওয়ায় দেশে ফিরতে পারছেন না। তবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে বৈধতা পাবেন বলে আশা তার। তখনই ফিরবেন প্রিয় মাতৃভূমিতে। প্রিয় মা, মাটি, স্বজন, প্রিয় সন্তান আর প্রেয়সীর কাছে।
 
এক মেট্রো স্টেশনে হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যে বসে যখন লিটনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন তার কণ্ঠ বাস্পরুদ্ধ। আবেগে ঠোঁট দুটি কাঁপছে থরথর করে। প্রবাস জীবনে মাসে যে আয় করেন, তাতে বেশ ভালোই আছে তার পরিবার। কেবল এটুকু পাওয়ার জন্যই তার বিদেশে থাকা।
 
লিটনের এই ফ্রান্সে আসা কিন্তু মোটেও সহজ ছিল না। হাজার হাজার কিলোমিটার পথ এজন্য তাকে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হয়েছে। পার হতে হয়েছে ধূসর তপ্ত মরুপথ, সুউচ্চ কাঁটাভরা পাহাড়, বরফে ঢাকা পর্বত শ্রেণী আর হিমবাহের বিদ্যুৎগতির স্রোতধারা। দীর্ঘদিনের এ যাত্রাপথে সাগরে হারিয়েছেন সহযাত্রীকে। ঠাণ্ডায় জমে নষ্ট হয়ে যাওয়া অঙ্গ হারাতে দেখেছেন প্রিয় বন্ধুর। স্বপ্নের ইউরোপ যাত্রার সেই লোমহর্ষক বণর্নাই তিনি দিয়েছেন বাংলানিউজের কাছে।
 
পথের বাকে বাকে ওঁত পেতে থাকা দালালের হাত ঘুরে ইউরোপে আসা লিটন বলেন, প্রথমে তারা ট্যুরিস্ট ভিসায় গিয়েছিলেন ভারতের পাঞ্জাবে। সেখান থেকে দালাল তাদের নিয়ে যান পাকিস্তানের করাচিতে। সেখানে কিছুদিন রাখার পর নিয়ে যাওয়া হয় আফগানিস্তানে। সেখান থেকে ইরানের বন্দর আব্বাসে। পাঞ্জাব থেকে এই পুরো রাস্তাই প্রায় পায়ে হেঁটে আসতে হয় চরাই-উৎরাই পার হয়ে। তবে শহরের কাছাকাছি আসার পর তাদের কৌশলে বিশেষ এক ধরনের গাড়িতে তুলে আস্তানায় নেওয়া হতো।
 
তিনি জানান, বন্দর আব্বাসে সিলেটিদের একটি কলোনি আছে। এখানকার বাসিন্দাদের সবাই যুগ যুগ ধরে এখন পর্যন্ত মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। তারা দালালির কাজ করে। এ নেটওয়ার্ক গ্রিস পর্যন্ত বিস্তৃত। তাদের গডফাদার আবার পাকিস্তানি আরিফ চৌধুরী। তিনি গ্রিসে থাকেন। তার সহযোগীর সংখ্যা ডজনখানেক বাংলাদেশি। এর মধ্যে রয়েছেন ফরিদপুরের নিজাম, মাদারীপুরের সেকেন্দার, রফিক, রজব আলীসহ আরো অনেকে। এই বাংলাদেশিরা বিভিন্ন দেশের আদমের (অভিযাত্রীদের) এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। তারা দুবাই, কাতার, ইরান, ইয়েমেন, সৌদি আরব, সিরিয়া, লিবিয়া, পাকিস্তান ও পাঞ্জাব থেকে আদম সংগ্রহ করেন। এসব দেশে আবার স্থানীয় পর্যায়ের সাব এজেন্ট আছে তাদের।
 
লিটন বলেন, বন্দর আব্বাসে এসেই মূলত সবাইকে ইউরোপীয় দালালদের হাতে পড়তে হয়। অধিক লাভের জন্য এখানে দালালরা অভিবাসীদের শুধু মারেন এবং টাকা আদায় করেন। এমনও ঘটে থাকে, এক দালালের হাত থেকে টাকার বিনিময়ে মুক্তি পেয়ে অসহায় মানুষ আর এক দালালের হাতে আটকে পড়েন। প্রকাশ্যে ঘরে বন্দি ইউরোপ গমনেচ্ছুদের নিলামের মাধ্যমে একদল অন্য দলের কাছে বিক্রি করে। সেই টাকা আদমের কাছ থেকে সুদে আসলে তুলে নেন দাললরা।
 
বন্দর আব্বাসের সবকিছু চুকে গেলে লিটনদের হাঁটিয়ে  নিয়ে আসা হয়েছিল ইরানের সারি সারি কাঁটাযুক্ত পাহাড় ডিঙ্গিয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে। সেখানে প্রথমে তাদের দাললদের ভাড়া করা বাসায় আটকে রাখা হয়। গরমের সময় এ রাস্তা পার হওয়া সম্ভব হলেও শীতের সময় তা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। পুরো পথই বরফে ঢেকে যায়। কিন্তু পুরনো এ পথে ইউরোপ অভিমুখী যাত্রীদের ঢল তাতে কমে না।
 
লিটন বলেন, এ পথে তার দলের এক সহযাত্রী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আরো কয়েকজন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ইস্তাম্বুলে পৌঁছান। ইস্তাম্বুলে এসে দালালেরা অন্য একদলের হাতে তুলে দেন অভিযাত্রীদের। থাকার স্থানও বদল হয়। মাটির নিচে দালালদের তৈরি করা বিশেষ ভাড়া ঘরে জড়ো করে রাখা হয়। ১২/১৪ জনের ছোট ছোট একাধিক দল থাকে এক একটি বাড়িতে। এখানেই গ্রিস সীমান্তে পৌঁছানোর জন্য টাকা আদায় করা হয় ইস্তাম্বুলে আসার টাকাসহ। যাদের টাকা নেই, তাদের পরিবারের কাছে ফোন করানো হয়। টাকা বা গ্রান্টার ঠিক হলে নতুন যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলা হয় অভিযাত্রীদের।
 
এখান থেকে সময় বুঝে দু’ভাবে ইউরোপ যাত্রা শুরু হয়। সাগরে টহল কম থাকলে ও অনুকূল আবহাওয়ায় নেওয়া হয় ট্রলার বা নৌকায় করে। নইলে হাঁটা পথে। লিটনদের নেওয়া হয়েছিল হাঁটিয়েই। কারণ, জাহাজডুবিতে তাদের আগের ব্যাচের প্রায় সবার মৃত্যু হয়েছিল। কেবল কুমিল্লার এক অভিযাত্রী প্রাণে বেঁচে ছিলেন। পরে তাকে হেলিকপ্টারে উদ্ধার করে ইস্তাম্বুলের বাংলাদেশ দূতাবাসে হস্তান্তর করেছিল তুরস্কের কোস্টগার্ড।
 
ইস্তাম্বুলের বাসা থেকে লিটনদের প্রথমে একটি গাড়ির গ্যারেজে নেওয়া হয়েছিল। সারাদিন এখানে অভুক্ত অবস্থায় রাখার পর সন্ধ্যার দিকে একটি কাভার্ডভ্যানে তোলা হয়।

৩/৪ ঘণ্টা চলার পর নামানো হয় একটি খোলা প্রান্তরে। পুরো এলাকাই তখন হিমবাহের গলা পানিতে একাকার। সেই হাঁটু সমান ঠাণ্ডা পানির পথ পার হতে হয় সারা রাত।

এখানেই লিটনদের দেখা হয় আরো অনেক অভিযাত্রী দলের সঙ্গে। সকালে উপত্যকার একটি ভেড়ার খামারে লুকিয়ে রাখা হয় তাদের। বিকেলে আবার হাঁটা শুরু হয়। সন্ধ্যায় ডংকাররা (দালালরা) সবার হাতে বড় সাইজের পলিথিন ব্যাগ ধরিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পরই ঘোষণা করা হয়, ‘লাইন ক্লিয়ার নেই, সবাই পলিথিনে ঢুকে শুয়ে পড়েন’। সারাপথেই থাকে দালাল চক্রের কড়া নজরদারি। একদল সব সময় স্যাটেলাইট ফোনে যোগাযোগ রাখছিল অন্যদলের সঙ্গে।
 
রাতের এক সময় তারা আবার হাঁটা শুরু করে এসে পৌঁছান বুলগেরিয়ার সীমান্তে। হিমবাহের এই উপত্যকা কিছুটা জটিল। তুরস্ক, গ্রিস ও বুলগেরিয়ার সীমান্ত মিশেছে এখানে। অন্ধকারের রাস্তা ভুল করার তাই সম্ভাবনা ছিল লিটনদের।
 
লিটন বলেন, ‘এখানেই আমাদের একটি প্লাস্টিকের লাইফবোট ও কিছু দড়ি দিয়ে একটি খাল পেরোতে বলা হয়। কিন্তু এক সময় দালালরা বুঝতে পারেন, হিমবাহের ঠাণ্ডা পানির এই খরস্রোতা পাহাড়ি খাল পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটলে বাঁচানো যাবে না কোনো অভিযাত্রীকেই। তাই সিদ্ধান্ত বদলে গ্রিসের বন বিভাগের জাহাজ ম্যানেজ করে খাল পার করা হয়। এবার আমরা গ্রিসের মাটিতে প্রবেশ করি। আবার হাঁটা শুরু হয় আমাদের। কেবল শুকনা চিড়া খেয়ে এ হাঁটা চলে দুপুর পর্যন্ত’।
 
তিনি বলেন, ‘দুপুরে আমরা একটা রেললাইনের ওপর এসে পৌঁছাই। এ সময় আমাদের  খেতে দেওয়া হয় একটি পাউরুটি ও কিছু শুকনো জলপাই। তবে কোনো পানি ছিল না। পাশের ঝরনা থেকে পানি খেতে হয়। এবার শুরু হয় রেললাইন ধরে হাঁটা। এক সময় ট্রেন চলে এলে আমরা সবাই পাশের গাছে চড়ে বসি। ট্রেন চলে গেলে এবার হাঁটতে হাঁটতে একটি পাহাড়ি গুহায় ঢোকানো হয় আমাদের। এখানে চলে অপেক্ষা’।
 
লিটন জানান, ‘এক সময় দু’টি সাদা ট্যাক্সি এসে পৌঁছায়। পেছনের তিন সিটে পাঁচজন এবং পেছনের বনেটের মধ্যে দু’জন করে মোট ১৪ জন রওনা হন একসঙ্গে। ঘণ্টাখানেক পর ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। এখানে অপেক্ষা করার পর পর আরিফ চৌধুরীর বিশেষ ধরনের গবাদিপশু টানার গাড়ি এসে পৌঁছায়। সেই গাড়িতে করে সাড়ে ৫ ঘণ্টা পর নিয়ে যাওয়া হয় গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে’।
 
লিটন বলেন, ‘এথেন্সে আসার পর একটি বাড়িতে এনে রাখা হয় একদিন। সেখানে আমাদের গোসল ও বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া হয়। পরে গ্রান্টারদের ফোন দিয়ে টাকা আনতে বলা হয় অথবা দেশে ফোন করে দালালদের এজেন্টদের পরিবারের কাছে টাকার জন্য পাঠানো হয়। এজেন্ট ওকে করলেই অভিযাত্রীদের বিশেষ কায়দায় বিভিন্ন স্থানে নামিয়ে দেওয়া হয়’।
 
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ এ যাত্রাপথে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছিল। শাহিন নামের একজনের ঠাণ্ডায় হাত নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর হাত কেটে ফেলতে হয়েছিল। গ্রিসে কিছুদিন থাকার পর অন্য দালালের মাধ্যমে ইতালি হয়ে পূর্ব ইউরোপীয় কযেক দেশে পার হয়ে ফ্রান্সে এসে থিতু হই’।
 
লিটন বলেন, গত ১০ বছরে দালাল আর পথের কোনো হেরফের হয়নি। প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ এ পথে প্যারিসে আসছেন। তাদের কাছ থেকেই প্রতিদিন এ পথের আপডেট জানতে পারি’।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৫
আরএম/এএসআর

** প্যালেস ডি সালভাদর দালি
** প্যা‌রিসে ম‌লিন আবহে বড়‌দিন
** গির্জাভিত্তিক পর্যটন
** এনভার্সে জাকিরের দেখা
** বাস্তিল ঘিরে পর্যটন
** প্যারিসের গণতন্ত্র ময়দান
** বাতাক্লঁয়ে প্রতিদিনই আসছে মানুষ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।