ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

আম্মুর ফোন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৯ ঘণ্টা, মে ১০, ২০২০
আম্মুর ফোন ছবি প্রতীকী

ভাবতেই কষ্ট লাগে ঠিক চার বছর আগে এই নম্বর থেকে শেষবারের মত ফোন এসেছিলো। স্পষ্ট মনে আছে সেদিন হাসপাতালে ডিউটি শেষে মাত্র বাসার পথ ধরছি। এমন সময় ক্ষীণকণ্ঠে আম্মুর ফোন, বাঁধন আমার কেমন যেন লাগছে!

আকস্মিক বিপদে দুশ্চিন্তা আর উৎকণ্ঠায় বাসায় ফিরে অচেতন আম্মুকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক জানান ব্রেইন হেমোরেজ হয়েছে। তারপর থেকে আর কখনো আম্মুর সঙ্গে কথা বলা হয়ে ওঠেনি।

তবুও চার বছর ধরে এই নম্বরটা যত্নের সঙ্গে মোবাইলে সেভ করে রেখেছি। প্রায়ই কারণে-অকারণে ফোনের কন্টাক্ট নম্বর স্ক্রল করলে সবার আগে আম্মু নামটি ভেসে ওঠে।

এখনো কারও ফোনে পরিচিত রিংটোনটা বাজতেই আম্মুর ফোন ভেবে সচকিত হই। কিন্তু আফসোস! শত অপেক্ষার পালা শেষ হলেও সেই চিরচেনার নম্বর থেকে ফোন আসে না। আম্মুর দরদ মাখানো কণ্ঠও শুনতে পাই না!

সপ্তাহখানেক আগে তরুণী বয়সের এক রোগী চোখের সমস্যা নিয়ে আমার চেম্বারে এসেছিলেন। হঠাৎ তার মোবাইলফোনটি বেজে ওঠায় যথারীতি রিসিভ করে অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে যা বলছিলো তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। কথপোকথন শুনে বুঝতে পারছিলাম মেয়েটির মা ফোন করেছিলেন। কারণ সে ফোনে বলছিলো আম্মু তোমাকে কতবার বললাম আমি হাসপাতালে পৌঁছে গেছি! আমি এখন ডাক্তারের চেম্বারে, বারবার কেন ফোন করছো? শেষে রাজ্যের বিরক্ত নিয়ে নিচু স্বরে অসহ্য বলছিলো ফোনটা কেটে দিলেন! মেয়েটির আচরণে কেন জানি আমার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠছিলো। অজান্তেই মনের পর্দায় আম্মুর মুখোচ্ছবি ভেসে উঠছিলো। যাহোক রোগী দেখে ছেড়ে দেওয়ার পর কোনো একদিন আমার ও আম্মুর সঙ্গে ঘটে যাওয়া এমন এক মুহূর্ত মনে পড়ে খুব আফসোস লাগছিলো।

অনেকরই হয়তো মনে আছে ২০০৫ সালে একবার জঙ্গিগোষ্ঠী (জেএমবি) একযোগে বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় সিরিজ বোমা হামলা চালিয়েছিলো। মেডিক্যালের শিক্ষার্থী হওয়ায় সেদিন ক্লাসে ছিলাম। তাই বাইরে ঘটনা বুঝতে পারিনি। এমন সময় আম্মুর মোবাইল থেকে ফোনকল আসা শুরু হলো।

এদিকে স্যার ক্লাসে থাকায় যতবারই কল কেটে দেই আম্মুও ততবার ফোন দিয়েই যাচ্ছিলো। ক্লাসে আছি জানার পরও ক্রমাগত ফোনে খুব রাগ হচ্ছিল। মিনেট বিশেক পর ক্লাস শেষে অনকেটা রাগ করেই ওই মেয়েটির মত ফোন করে বলছিলাম কি আম্মু! তুমি জানো না আমি ক্লাসে? কেন এতবার ফোন করছো? হঠাৎ ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে কান্নার শব্দে আর কিছু না বলে চুপ হয়ে গেলাম। ভয়ার্ত স্বরে আম্মু বারবার জিজ্ঞেস করে যাচ্ছিল বাঁধন আব্বু তুমি কি ঠিক আছো? তুমি ফোন কেন ধরছোনা কেন? সব জায়গায় বোমা হামলা হয়েছে! আর তুমি ফোন ধরছো না দেখে ভয় পেয়ে গেছিলাম। তারওপরও রাগ দেখিয়ে বলছিলাম, আমি ভালো আছি, তারপরও ক্লাসের মধ্যে ফোন করেই যাচ্ছো? তখন অপর প্রান্তে থাকা আম্মু আবেগ মিশ্রিতভাবে বলছিলো ‘যেদিন আমি থাকবো না!

সেদিন বুঝবে আব্বু!’ সত্যিই সেদিন আম্মুর ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর বুঝতে পারিনি। এখন আফসোস হয় কেন বুজতে পারিনি এত ভালোবাসা? মাঝেমধ্যে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় আম্মু তুমি প্লিজ ফোন করো, একটি বারের জন্য হলেও ফোন করো, আমি সারাদিন সবকাজ ফেলে তোমার সঙ্গে কথা বলবো, প্লিজ আম্মু একটিবার ফোন করো!

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইস্পাহানী ইসলামিয়া আই হাসপাতাল, ঢাকা।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, মে ১০, ২০২০
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।