ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

টলেমির মানচিত্র

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৭
টলেমির মানচিত্র মানচিত্রের গল্প।

সপ্তম অধ্যায়
আজকের মিশর বা তৎকালে গ্রিক শাসিত আলেকজান্দ্রিয়া নামক দেশের নীল নদের উজানে একটি ওয়েসিস বা বড় কূপ ছিল। সেই কূপকে ঘিরেই পরিমাপ করা হয় পৃথিবীর পরিসীমা।

সূর্য বিষুবরেখার উপরে আসে ২১ মার্চ ও ২৩ সেপ্টেম্বর, আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিয়ান এরাটোসথেনিস এসব জানতেন। তিনি ২১ মার্চের কথা মনে রেখে কূপের দূরত্ব মাপবার জন্য এক উটের বাহিনী পাঠিয়ে দিলেন।

দূরত্ব মাপা হল। ওই বিশেষ স্থানটি কত ডিগ্রিতে তা-ও তার জানা। এবার লাইব্রেরির সামনে একটা সূর্যঘড়ি, মানে একটা লম্বা খুঁটিতে একই সময়ে মাপলেন ছায়া। দুই বিন্দুতে একটি ত্রিভুজ করে বৃত্তের পাঁচ ভাগের এক ভাগ তিনি হাতে পেলেন। এরপর সামান্যই কাজ। হিসাব করে বললেন পৃথিবীর পরিসীমা ২,৫০,০০০ স্ট্যাডিয়া বা ৪৬,২৫০ কিলোমিটার। সামান্য ভুলচুক হতে পারে ভেবে অঙ্কটা পাকাপাকিভাবে ধার্য করলেন ৪৬ হাজার কিলোমিটার।

ক্লডিয়াস টলেমি।  আসলের চেয়ে শতকরা ১৬ ভাগ বড় হয়ে গেল বটে, কিন্তু কৃতিত্বের দিক থেকে সন্দেহের সুযোগ নেই। কারণ, তার হাতে কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না। হিসাবের গড়মিলের কারণ, উটের বাহিনী দূরত্ব ঠিক মতো মাপতে পারে নি। ডিগ্রি তথা অক্ষাংশের মাপেও ভুল ছিল। একালে পৃথিবীর পরিধি ধরা হয় ৪০ হাজার কিলোমিটার। সুতরাং সর্বকালের পণ্ডিতদের সিদ্ধান্ত: ওই গ্রন্থাগারিক ‘বিটা’ ছিলেন না, ছিলেন ‘আলফা’ বা প্রথম শ্রেণির একজন, ‘বিটা’ বা দ্বিতীয় শ্রেণির ছিলেন তারাই, যারা তার প্রতিভা পরিমাপ করতে পারে নি। তিনিই ছিলেন অকৃত্রিম ও প্রকৃত ‘আলফা’।

মানচিত্র প্রসঙ্গে বার বার আলেকজান্দ্রিয়া আলোচনায় আসে। সেই বিশ্বনন্দিত গ্রন্থাগার, সময়কাল খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতক। যদিও আলেকজান্দ্রিয়ার আগেকার শক্তি ও ঐশ্বর্য আর নেই। তবু জনসংখ্যায় তৎকালীন বিশ্বের প্রধান শহর সেটি। রোমের পরেই এর স্থান। বিদ্যাকেন্দ্ররূপে আলেকজান্দ্রিয়া তখনো অবশ্য রোমের চেয়ে অনেক বেশি খ্যাতিমান। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারে তখন কাজ করছেন ক্লডিয়াস টলেমি নামের এক পণ্ডিত। যার কর্মজীবন ১২৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত।  

এই লাইব্রেরিয়ান মিসরের টলেমি-রাজাদের কেউ নন। তিনি গবেষক ও জ্ঞান পিপাসু। তার চর্চার বিষয় সঙ্গীত, গণিত আর দৃষ্টিবিজ্ঞান বা আলোকবিদ্যা। কিন্তু বিশ্বজোড়া তার খ্যাতি প্রধানত দুটি বইয়ের জন্য। একটির বিষয় জ্যোতির্বিদ্যা, আরেকটির ভূগোল।

এহেন টলেমি পৃথিবীর একটি মানচিত্র এঁকেছিলেন। তাছাড়া তার ভূগোল গ্রন্থে ছিল আরও ২৬টি আঞ্চলিক মানচিত্র। সেগুলো তার নিজের আঁকা কি-না, নিশ্চিত বলা যায় না। মানচিত্র প্রণয়নে তার বক্তব্য ছিল তৎকালীন জগতের বিবেচনায় অভিনব। তার মতে, “মানচিত্রে কেবল শহর-জনপদ, পর্বত ও বড় বড় নদী থাকলেই চলবে না, এসবের অন্তর্গত বিশেষ চরিত্রলক্ষণাদিও অনুধাবণ করতে হবে। ”

প্রকারান্তরে তিনিই প্রথম ‘থিমেটিক ম্যাপ’-এর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন। মানচিত্র রচনায় তিনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্তারোপ করেছিলেন। তা হলো, “মানচিত্রে অবশ্যই ‘স্কেল’ বা পৃথিবীর অনুপাতে বিশেষ দেশ ও দ্রষ্টব্যের পরিমাপ নির্দেশ করতে হবে। ”

টলেমির মানচিত্র।  টলেমির মানচিত্র ছিল সেকালের জ্ঞাত পৃথিবীর মানচিত্র। ফলে তাতে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যকে খুবই বড় করে দেখিয়ে এশিয়া-আফ্রিকাকে খুবই সঙ্কুচিত করে দেখানো হয়েছে। কারণ এশিয়া ও আফ্রিকা সম্পর্কে তখন তাদের বিশেষ কোনও ধারণা ছিল না।   কিন্তু সে মানচিত্রটি অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ বিহীন নয়। এসব কারণেই বিশেষজ্ঞদের মতে বিজ্ঞানসম্মত মানচিত্রের সংজ্ঞা ও আদি জ্ঞান যিনি নির্ধারণ করেন, তিনি এই ক্লডিয়াস টলেমি।

টলেমির একশ’ বছর পর আলেকজান্দ্রিয়া পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। বিদ্যাচর্চা ততদিনে অন্তর্হিত। চারিদিকে যুদ্ধ, দাঙ্গা, বিদ্রোহ, বিক্ষোভ ও আগুন। পাঁচশ’ বছরের পুরনো গ্রন্থাগার বিধ্বস্ত। অবশিষ্ট যা ছিল, উন্মত্ত খ্রিস্টান জনতা তা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে। গ্রন্থাগারের খোলসে অতঃপর গড়ে তোলা হয় একটি গির্জা। উগ্র-খ্রিস্ট ধর্মীয় অন্ধত্বের কাছে নিহত হয় যুক্তি বা জ্ঞানের প্রতীক লাইব্রেরি। এটা হল খ্রিস্টিয় মধ্যযুগের অন্ধকার কাল।

পরবর্তী  হাজার বছর ধরে ক্লডিয়াস টলেমি এবং তার মতো আরও অনেক বিশ্বখ্যাত জ্ঞানী-বিজ্ঞানী-পণ্ডিতও পরিণত হন বর্বর আক্রমণের কারণে লুপ্ত-নামে। ইতিহাসে পশ্চিমী জগতকে তখন দেখা যায় অন্ধ ও উন্মত্তরূপে। জ্ঞান-বিজ্ঞান-যুক্তি-দর্শনের মতো কাকে বলে বিজ্ঞানসম্মত মানচিত্র, কী তার সঠিক রচনা পদ্ধতি, কিছুই জানতো না অন্ধ-ইউরোপ। কারণ খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতক থেকে চতুর্দশ শতক পর্যন্ত সময়কাল ইউরোপে অন্ধকারময়-মধ্যযুগ। ইউরোপের সে পৃথিবী তসমাবৃত, রক্তাক্ত, আগুনে নারীদের পুড়িয়ে মারার কাল। যদিও আরব, ভারত, চিন তখন আলোকিত।

প্রাচীন সূর্যঘড়ি।  অতএব অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপে সঠিক মানচিত্র রচনার প্রশ্নই ওঠে না। যে সব মানচিত্র তখন আঁকা হচ্ছিল, তা চরিত্র ও বৈশিষ্টে স্বর্গীয় ও কাল্পনিক। তা ছিল বাস্তবের ধরা-ছোঁয়ার বাইরের বিষয়। তৎকালের ইউরোপিয়ান পণ্ডিতরা এমনকী নিজেদের শহরের পাশের শহরের অক্ষাংশও জানতেন না! ফলে চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে তৈরি একখানা মানচিত্র বাদ দিলে ইউরোপে মানচিত্র নামে আর যা কিছু প্রচলিত ছিল, সবই উদ্ভট কল্পনার ফসল।

পূর্ববর্তী পর্ব
মানচিত্র চর্চায় একজন ‘পেনথালস’

পরবর্তী পর্ব
চুম্বক, কম্পাস ও ‘বাতাসি গোলাপ’

বাংলাদেশ সময়: ০০০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৭
এমপি/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।