ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

এই সময়ে রাতারগুলের নির্জনতায়

আসিফ আজিজ, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫০ ঘণ্টা, মে ২০, ২০১৭
এই সময়ে রাতারগুলের নির্জনতায় সিলেটের জলারবন রাতারগুল/ছবি: আসিফ ‍আজিজ

সিলেট থেকে ফিরে: গাছঘেরা টিলাচূড়ায় হঠাৎ গুমরে উঠলো কালো মেঘ। সঙ্গে কলার থোড়ের মতো সাদা বিদ্যুতের ঝলকানি। বনবিভাগের নির্জন বাংলোয় আটকে রাখার ফন্দি আঁটছে যেন প্রকৃতি! বাংলো থেকে দেখা যায় সিলেট শহরের অনেক ঘরের ছাদ-চাল। চারপাশে বাগান। অনেকটা লাভা, দার্জিলিয়ের মতো। যাইহোক ‘মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে কে ডাকে আয় ‍আয়’ কবির উপর ভরসা রেখেই নয়জনের দল চেপে বসা হলো মাইক্রোবাসে। ঘুরতে এসে কি ভয় আর ঘুমালে চলে! সবার ছোট সুমেহেরাসহ সবাই তাই রেডি সেই সকাল ৭টায়।

টিলা থেকে আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে নেমে গন্তব্য সিলেটের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ রাতারগুল ও বিস্নাকান্দি (সিলেটি ভাষায়)। তার আগে নতুন রেস্টুরেন্ট ডিঙিতে নেহারি আর পরাটায় সারা হলো প্রাতঃরাশ।

অল্প সময়ে বেশ নাম করেছে এলাকার রেস্টুরেন্টটি। বিশেষ করে চায়ের জন্য। এখানে এসে এককাপ করে চা পানে কারও পোষালো না। ২০-৩০ রকম চা হয় চায়ের দেশের এ রেস্টুরেন্টে। তানজিল তো হাতে কলমে দেখিয়ে দিলো চা দেখেও জিহ্বায় জল আসে!
রাতারগুল যাওয়ার বেহাল সড়ক/ছবি: আসিফ ‍আজিজ
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলেও কিছুক্ষণ পরেই কবির কথা সত্য হলো। মেঘ ফুঁড়ে উঁকি দিলো সূর্য। দেশের সবচেয়ে পুরনো চা বাগান মালনিছড়ার পাশ দিয়ে বিমানবন্দর সড়কে প্রবেশ করতেই মুখোমুখি হতে হলো ভয়ংকর সড়কের। ঝরনাধারার মতো সড়কের মাঝ দিয়ে বয়ে আসছিলো পানির স্রোত। চালকের কাছে জানা গেলো সামনে ধোপাগুল থেকে সড়ক আরও খারাপ। বছরখানেক আগে যাওয়া সড়কের অবস্থা যে আরও খারাপ হয়েছে তা বুঝতে বাকি রইলো না।

যাইহোক ২৬ কিলোমিটার রাস্তা যেন শেষই হচ্ছিলো না। দু’পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও ম্লান হয়ে যাচ্ছিলো সড়কের দোলাচলে। ধোপাগুল এসে ডানে মোড় নিয়ে যেতে হবে গোয়াইনঘাট উপজেলার রাতারগুল। কিন্তু সেখানে গিয়ে মনে হলো রাস্তা শেষ। কারণ সামনে পানি ছাড়া দেখা যাচ্ছিলো না রাস্তা। অন্যতম পর্যটক আকর্ষণের রাতারগুলের প্রতি সরকারের এ বিমাতাসুলভ আচরণ সত্যি দুঃখজনক।
নালা দিয়ে ঢুকছে মূল রাতারগুল বনে/ছবি: আসিফ ‍আজিজ
৪০ মিনিটের রাস্তা প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টায় পৌঁছালাম। ততক্ষণে বৃষ্টি তো নেই, উল্টো রোদ তেঁতে উঠেছে। আমাদের গন্তব্য ছিলো মটরঘাট। এছাড়া ফিরিঙ্গি ও রাতারগুল ঘাট দিয়েও যাওয়া যায় রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট বা জলারবন। জানা গেলো সিলেটে বৃষ্টি হয় প্রতিদিনই। তবে দিনে নয়, রাতে। তাই রাতারগুল, বিস্নাকান্দি মে মাসে যেতে কোনো সমস্যা নেই। বরং প্রকৃতিতে নতুনের ছোঁয়া। সিলেট ভ্রমণের জন্য বর্ষাই উপযুক্ত মৌসুম।

ঘাটে পৌঁছে এবার নৌকা ঠিক করার ঝক্কি। প্রথমে চেয়ে বসলো ১৬শ ৫০ টাকা। আগে থেকেই জানা ছিলো নৌকাভাড়া ঘণ্টাপ্রতি ৫শ টাকার বেশি নয়। ছোট নৌকাগুলোতে ৪ থেকে ৬ জন চড়াই ভালো। আমাদের নয়জনের জন্য দুই নৌকা রফা হলো ৮শ টাকায়।
রাতারগুলের ওয়াচটাওয়ার/ছবি: আসিফ ‍আজিজ
পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ পানি দিয়ে বেতবাগানের পাশ দিয়ে চিকন নালাপথে ঢুকলো রাতারগুল বনের দিকে। চালক দু’জন করে। একজন শিশু। পানি একটু কম থাকায় কিছুদূর নেমে ঠেলতে হয়। সরকারের অধীনে নেওয়ায় এখন কেউ বেত কাটতে পারে না। তাই বাগান বেশ ঘন। শীতলপাটি বোনার গাছ ‘মোতা’ প্রচুর সংখ্যক। পানির মধ্যে তিন-চার ফুটের গাছ হয়। তবে হিজল, কড়স এখানকার মূল গাছ। পানির মধ্যে টিকে থাকার অসীম ক্ষমতা এ গাছের। নালাপথ দিয়ে নৌকা ছুটতে থাকলো বনের দিকে। সঙ্গে ছুটতে থাকলো সেলফির ফুলকি!
টাওয়ার থেকে রাতারগুল/ছবি: আসিফ ‍আজিজ
দু’পাশে গাছঘেরা নালা দিয়ে বনে ঢুকতেই কিছুদূর নৌকা ঠেলতে হলো। এরপর আবার চলা শুরু। চারদিকে সুনশান নীরবতা। মাঝে মধ্যে শুধু নৌকার হাল ভাঙার শব্দ। আর একটি বউ কথা কও পাখির অবিরাম ডেকে চলা। সে ডাক অভিমানের কিনা বোঝা গেলো না! একটু এগোতেই দেখা দিলো বনবিভাগের পরিদর্শন টাওয়ার। টাওয়ারের পাশেই রয়েছে ভাসমান একটি দোকান। নৌকায় সেখানে পর্যটকদের জন্য শুকনো খাবার নিয়ে বসে থাকেন এক যুবক। বেচাকেনাও বেশ হয় নাকি।
টাওয়ার থেকে রাতারগুল/ছবি: আসিফ ‍আজিজ
মুহূর্তে চারদিক থেকে পর্যটক আসায় বেশ জমে গেলো টাওয়ার এলাকা। কম্পমান পাঁচতলা সমান টাওয়ারের উপর থেকে অসাধারণ লাগে ৫শ একরের বেশি জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা দেশের একমাত্র এ জলারবন। সুন্দর দেখতে তাই কিনা জানিনা, তবে বনের পথে প্রবেশমুখে লেখা ‘সুন্দর বন’।

মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা পানিতেই নাকি যৌবন ফেরে রাতারগুলের। টাওয়ার থেকে চারপাশের ভাসমান বন দেখা যায়। পর্যটনের জন্য আগে নির্দিষ্ট মাস, সময় ছিলো। এখন সেটা যে নেই তা মে মাসে গিয়ে বোঝা গেলো। ঘাটে নৌকা নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি ছিলো বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে।
রাতারগুলের নির্জনতায়/ছবি: আসিফ ‍আজিজ
টাওয়ার তেকে ছবি তোলা শেষে ফের নৌকায় চেপে এবার অন্যপথে ঘাটের দিকে এগোতে থাকলো নৌকা। মাঝে মধ্যে দুই নৌকায় রেসও চললো। রাতারগুলের অন্যতম সৌন্দর্য ঘনবনের সর্পিল হিজল-কড়সের ডালপালার ছায়ায় মত্ত থাকা নিচের স্বচ্ছ পানি। এ যেন জল ছায়ার খেলা। বন যখন আরও ড‍ুবে যায় তখন সে খেলা হয়ে ওঠে আরও মোহনীয়। নানা ধরনের পাখ-পাখালি ও সরীসৃপ প্রাণীর বাস এ জঙ্গলে। বানরও দেখা মেলে ভাগ্য ভালো হলে।

ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলো না আমাদের। দেখা পাইনি কোনো প্রাণীর। ঘণ্টাখানেক নির্জনতা উপভোগ হলো শহরের কোলাহল ছেড়ে। রাতারগুলের মতো বন জীবনের অর্থ যেন বদলে দেয় কিছুক্ষণের জন্য। এটাই পাওয়া। ফিরতি পথে দূর থেকে ফের শোনা গেলো সেই আকুতি ‘বউ কথা কও’।
বনের হিজল-কড়স গাছ/ছবি: ‍আসিফ
যাওয়া, থাকা-খাওয়া:
ঢাকার মহাখালী, যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে সিলেটের বাস রয়েছে ‍আধাঘণ্টা পর পর। ভাড়া ননএসি ৪৫০-৫০০, এসি ৮০০-১২০০। ট্রেন রয়েছে সকাল সাড়ে ৬টায় পারাবত, দুপুর ১২টার পর উপবন ও বিকেলে কালনী। ভাড়া ৩২০-৫৬০। সিলেট শহর থেকে মাইক্রোবাস ভাড়া করলে সারাদিনের জন্য নেবে ৫ হাজার টাকা। রাতারগুল ও বিছানাকান্দি যেতে পারবেন একদিনে। শুধু রাতারগুল ২ হাজার। এছাড়া সিএনজি অটোরিকশা রিজার্ভ নেবে ৫শ-৮শ টাকা।

থাকার জন্য সব মানের হোটেল রয়েছে। ভাড়া ৫শ থেকে শুরু। খাওয়ার জন্য পানসী, পাঁচভাই বাছাই করতে পারেন। মান ভালো। ভালো চা পাবেন ডিঙিতে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫০ ঘণ্টা, মে ২০, ২০১৭
এএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad