ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

পর্ব ২৭

ষড়যন্ত্রের আখড়া ঘসেটির প্রাসাদ 

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৫ ঘণ্টা, মে ৭, ২০১৭
ষড়যন্ত্রের আখড়া ঘসেটির প্রাসাদ  মুর্শিদাবাদের পথে পথে

মুর্শিদাবাদ ঘুরে: মতিঝিল বা মুক্তাহ্রদের মধ্যেই ছিলো ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ। স্ত্রীর জন্য দামী পাথর দিয়ে এ প্রাসাদটি তৈরি করেন নওয়াজেস মহম্মদ খাঁন। আলীবর্দী খাঁর ছিলো তিন মেয়ে।

তার বড়মেয়েই মেহেরুন্নেসা বা ঘসেটি বেগম। আলীবর্দী তার তিন মেয়েকে বড়ইভাই হাজী আহমদের তিন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেন।

ঘসেটি বেগমের সঙ্গে বিয়ে হয় নওয়াজেস মহম্মদ খাঁনের।  
  
এই নওয়াজেস মহম্মদ খাঁনকে আলীবর্দী প্রথমে ঢাকার নায়েবে নাজিম নিযুক্ত করেন। পরে ঢাকার (শুধু বাংলার; বিহার ও ওড়িষ্যার নয়) নবাবও করেন।  

মতিঝিল বাগানের অংশবিশেষ

নওয়াজেস মহম্মদ খাঁ তার স্ত্রী ঘসেটি বেগমকে মতিঝিলের এই প্রাসাদটি বানিয়ে দেন।  

ঘসেটি বেগমের কোনো সন্তান ছিলো না। তাই তিনি তার বোন আমিনা বেগমের ছেলে সিরাজ-উদ-দৌলার ছোট ভাই ইকরাম-উদ-দৌলাকে পালক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। কিন্তু ইকরাম অল্প বয়সেই বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, ফলে নওয়াজেস খাঁ খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েন।  

কথিত রয়েছে, তিনি মানসিকভাবে অসুস্থও হয়ে গিয়েছিলেন। এর অল্পকিছুদিন পরে তিনি মারা যান। মতিঝিলেই তার ও ইকরাম-উদ-দৌলাসহ আরও কয়েকজনের সমাধি রয়েছে।  

স্বামীর মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি নিজের হস্তগত হয়। সেই সঙ্গে নবাব কন্যার মর্যাদা প্রয়োগ করে ঘসেটি বেগম প্রচুর ধন-সম্পদ সঞ্চয় করেন।  

ঘসেটি বেগম ছিলেন উচ্চাভিলাষী। আলীবর্দী তার ছোটো মেয়ের ছেলে সিরাজ-উদ-দৌলাকে তার উত্তরাধিকার মনোনীত করলে ঘসেটি বেগম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। প্রতিহিংসা পরায়ণ এ নারী এবার তার দ্বিতীয় বোনের পুত্র শওকত জংকে সিংহাসনে বসানোর জন্য নানা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেন। কিন্তু সিরাজ নবাব হওয়ার পর বিদ্রোহী শওকত জং-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন।  

মতিঝিল গেটি

ইকরাম-উদ-দৌলার মৃত্যু ও শওকত শংয়ের পরাজয়ের ফলে ঘসেটি বেগমের প্রতিহিংসা চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। সিরাজকে মসনদ থেকে হটানোর ষড়যন্ত্রের প্রধান কারিগর হিসেবে আবিভূর্ত হন তিনি।  

শুধু তাই নয়, সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রধান আখড়াবাড়ি ছিলো ঘসেটি বেগমের এই মতিঝিলের প্রাসাদ। ইংরেজদের কাসিমবাজার কুঠি ও মতিঝিলের ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ ছিলো ষড়যন্ত্রের মূল পরিকল্পনা কেন্দ্র। সিরাজ পরে বাধ্য হয়েই কাসিমবাজার কুঠি ও মতিঝিলে আক্রমণ করেন। কিন্তু তাতেও তাদের ষড়যন্ত্র বন্ধ হয় না।  

ঘসেটি বেগম এবার মীরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, উমিচাঁদের সঙ্গে হাত মেলালেন। সিরাজকে হটানের সভাগুলো বেশিরভাগই হতো মতিঝিলে। ঘসেটি বেগম এ কাজে মীরজাফর চক্রের পেছনে প্রচুর অর্থ ঢেলেছেন।  

ঘসেটি বেগমের ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে। পলাশির যুদ্ধ নাটকে মীরজাফর চক্রের বিশ্বাসঘাতকতার কাছে সিরাজের পরাজয় হয়। কিন্তু বাংলার ললাটে চিরদিনের মতো কলঙ্ক তিলক লেগে যায়।

নওয়াজেস মহম্মদ খাঁনের সমাধি

মতিঝিলের এই চত্বরেই ছিলো ঘসেটি বেগমের সেই প্রাসাদ। পাথরে এ প্রাসাদ আজ আর নেই। মাটির সঙ্গে মিশে গেছে বহু আগেই।  

আসলে বিশ্বাসঘাতকের পরিণতি কখনই ভালো হয় না। ঘসেটি ও ইংরেজদের হাত ধরে মীরজাফর ক্ষমতায় বসে প্রথমে সেই ঘসেটি বেগমের বিরুদ্ধেই ব্যব্স্থা নিলেন। মীরজাফর প্রথমেই সিরাজ মাতা আমিনা বেগম ও ঘসেটি বেগমকে বন্দি করেন। মীরজাফর নবাব পরিবারের ওপরই প্রথম হাত দিলেন।  

শুধু তাই নয়, আমিনা ও ঘসেটিকে মুর্শিদাবাদ থেকে ঢাকায় নিয়ে এসে জিনজিরা প্রাসাদে বন্দি করে রাখা হয়। কিন্তু মীরজাফরের পুত্র মীরন তাতে নিরাপদ বোধ করতে পারেননি। তাই ঘসেটি বেগমকে তাদেরকে আবার মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। একেই বলে পাপ কাউকেই ছাড়ে না। যতোদূর জানা যায়, ঘসেটি বেগমকে নদীতে ডুবিয়েই মারা হয়েছিল।  

মতিঝিল
মতিঝিলের এখন দুইটি অংশ। একটি অংশে রয়েছে নওয়াজেস খাঁর মসজিদ ও তার সমাধি। এরপরেই রয়েছে মতিঝিল বা হ্রদটি। এই হ্রদের মাঝখানেই ছিলো ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ। পলাশির পরাজয়ের পর লর্ড ক্লাইভ এই প্রাসাদে লুটপাট চালান। ঝিলের ওপারেই ক্লাইভ তার নিজের জন্য বাংলো বানিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলার বুকে মতিঝিলেই ব্রিটিশরা প্রথম প্রাসাদ তৈরি করে বসবাস শুরু করে।  

বর্তমানে মসজিদ ও সমাধি ছাড়া পুরনো সেই মতিঝিলের কিছুই নেই। সেই ষড়যন্ত্র নেই, ঘসেটির প্রাসাদ বা ক্লাইভের সেই বাংলোও আজ আর নেই। রয়েছে শুধু একটি হ্রদ, হয়তো একটি জাতির পরাজয় আর গ্লানির নীরব অশ্রুবিন্দু হয়ে। মতিঝিলের নোনা জল যেনো একটি জাতির অশ্রুবারি, এর ওপর দিয়ে ভেসে আসা বাতাসে কান পেতে শুনি আমারই পূর্ব পুরুষের অস্ফূট ক্রন্দনরব।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৭ ঘণ্টা, মে ০৭, ২০১৭

আগের পর্ব পড়ুন:
** ১ম পর্ব: এক যে ছিলো মুর্শিদাবাদ
** ২য় পর্ব: কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ
** ৩য় পর্ব: মানুষ যে হায় ভুলে গেছে চির মধুর ভালোবাসা
** ৪র্থ পর্ব: চার ভাইয়ের বাগান বিলাস ও একটি গুপ্তপথ
** ৫ম পর্ব: জগৎশেঠকে সপরিবারে হত্যা করা হয় যে প্রাসাদে
** ৬ষ্ঠ পর্ব: নুরলদীনের ‘জাগো বাহে’ শোনা যায় নসীপুর প্রাসাদে
** ৭ম পর্ব: কিরীটেশ্বরী মন্দির ও জগদ্বন্ধু সুন্দরের আশ্রম
** ৮ম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর কলিজাখেকো মেয়ের সমাধি!
** ৯ম পর্ব: হেস্টিংসের স্ত্রী, মেয়ের সমাধি ও একটি আর্মেনিয়ান চার্চ
** ১০ম পর্ব: মুজিবনগর ও পলাশী: বাংলার ইতিহাসের দুই আম্রকানন 

** ১১তম পর্ব: ৩শ বছরের ডাচ সিমেট্রি ও যোগেন্দ্র নারায়ণের মন্দির
** ১২তম পর্ব: সতীদাহ ঘাটের পাতালেশ্বর মন্দির

** ১৩তম পর্ব : আশি টাকার গাড়ি ও সোনার রথ
** ১৪তম পর্ব : ষড়যন্ত্রের গ্রিনরুম ছিল কাসিম বাজার

** ১৫তম পর্ব: কাসিম বাজার ছোট রাজবাড়ির বড় আয়োজন
** ১৬তম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর জগৎজয়ী কামান
** ১৭তম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি
** ১৮তম পর্ব: ফুটি মসজিদ: নির্মাণের অপেক্ষায় ৩শ বছর
** ১৯তম পর্ব: রোশনিবাগে শুয়ে আছেন নবাব সুজাউদ্দিন
** ২০তম পর্ব: মুর্শিদাবাদের শেষ নবাবের প্রাসাদ
** ২১তম পর্ব: বৈচিত্র্যময় মুর্শিদাবাদের খাবার
** ২২তম পর্ব: গ্রামের পথে খোসবাগ থেকে রোশনিবাগ
** ২৩তম পর্ব: রেশম যুগের মুর্শিদাবাদ
** ২৪তম পর্ব: বাচ্চাওয়ালি কামান ও ইমামবাড়া
** ২৫তম পর্ব: হাজার দুয়ারি প্রাসাদে শেকলবন্দি নবাব
** ২৬তম পর্ব: রহস্যে ঘেরা ঘসেটি বেগমের ধনভাণ্ডার

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।