ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

শিল্পী এস এম সুলতানের ৮৬তম জন্মবার্ষিকী

শরিফুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৩ ঘণ্টা, আগস্ট ৯, ২০১০
শিল্পী এস এম সুলতানের ৮৬তম জন্মবার্ষিকী

১০ আগস্ট মঙ্গলবার বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের  ৮৬তম জন্মবার্ষিকী।   ১৯২৪ সালের ১০ আগস্টের এই দিনে এস এম সুলতান তৎকালীন মহকুমা শহর নড়াইলের চিত্রা নদীর পাশে শ্যামল ছায়াঘেরা মাছিমদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

তার বাবা মোঃ মেছের আলী, মা মাজু বিবি। মা আদর করে তাঁর চেহারার সঙ্গে মিলিয়ে  নাম রেখেছিলেন লাল মিয়া।


সুলতানের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৯২৮ সালে রুপগঞ্জ আশ্রম স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভতির্র মাধ্যমে। ১৯৩৩ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালীন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যয়ের পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় স্কুল পরিদর্শনে আসেন । এ সময়  লাল মিয়া তার একটি সুন্দর ছবি আঁকলে তৎকালীন জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়সহ অনেকে মুগ্ধ হন। শুরু হয় শিল্পী লালের রঙতুলি হাতে নতুন জীবন। শিল্পী হওয়ার মনোবাসনায় লাল মিয়া পাড়ি জমান কলকাতায় উদ্দেশ্যে। কোলকাতার কাশিপুরে নড়াইলের জমিদার বাড়িতে থেকে জমিদারপুত্র অরুণ রায়ের সহোযোগিতায় কোলকাতার আর্ট কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। পরীায় প্রথম স্থান লাভ করলেও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকায় ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। পরে বিশিষ্ট শিল্পসমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর হস্তেেপ ভর্তির সুযোগ পান। সোহরাওয়ার্দী সাহেব তার অমায়িক আচরণে মুগ্ধ হয়ে লাল মিয়াকে তার বাসায় থাকার সুযোগ করে দেন। এ সময় শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর মা তার নাম রাখেন শেখ মোহাম্মদ সুলতান ।

১৯৪৩ সালে সুলতান খাকসার আন্দোলন নামে একটি সেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। শিাজীবন অসমাপ্ত রেখেই ১৯৪৪ সালে তিনি বেরিয়ে পড়েন ভারত ভ্রমণে। কাশ্মীরের পাহাড়ে কিছুদিন একদল আদিবাসীর সঙ্গে বসবাস করেন। ১৯৪৬ সালে কাশ্মীর থেকে চলে আসেন সিমলায়, সেখানে তার প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয়। এই প্রদর্শনী তার শিল্পী জীবনের প্রথম স্বীকৃতি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের লাহোরে ও পরে করাচিতে অবস্থান করেন। এসময় নাগি, চুগতাই, শাকে আলী, শেখ আহম্মেদসহ অনেক বিখ্যাত শিল্পীর সাথে তার পরিচয় ঘটে। ১৯৫০ সালে চিত্রশিল্পীদের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আমেরিকা সফর করেন। সেখানে তিনি নিউ ইয়র্ক, বোস্টন, ওয়াশিংটন, শিকাগোসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। এখান থেকে তিনি পাড়ি জমান ইউরোপে। লন্ডনে এ সময় বেশ কটি একক ও যৌথ চিত্রপ্রদর্শনীতে অংশ নেন। যৌথ প্রদর্শনীতে তার ছবি সমকালীন বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, ডুফি, সালভাদর দালি, পল কি, মাতিসের ছবির সাথে প্রদর্শিত হয়। সুলতানই একমাত্র এশীয় শিল্পী যার ছবি এতজন গুণী শিল্পীর ছবির সাথে একত্রে প্রদর্শিত হয়। ইউরোপ ও আমেরিকা জয় করে এই শিল্পী ১৯৫৩ সালে দেশে ফিরে আসেন। কিছুদিন ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্রাবাসে অবস্থান করে ফিরে আসেন  মাতৃভূমি নড়াইলে।

১৯৫৫ সালে নড়াইলের কালিয়া উপজেলার চাচুড়িÑপুরুলিয়া নন্দনকানন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৬ সালে পল্লীকবি জসীমউদদীনের সাথে কয়েকদিন আবস্থান করেন। ১৯৫৮-৬৯ সালে যশোরের নীলগঞ্জ শশ্মানে মাঝে মাঝে ধ্যান করতেন শিল্পী । ১৯৬০ সালে যশোরের চাঁচড়ার জমিদারবাড়িতে কিছুকাল অবস্থান করেন। ১৯৬৫ সালে সবার অগোচরে আবার পশ্চিম পাকিস্তানে গমন করেন। হারিয়ে যাওয়া লাল মিয়াকে ১৯৬৭ সালে নড়াইলের অদূরে এক গ্রামে খুঁজে পাওয়া যায়। তৎকালীন যশোর জেলা প্রশাসক এনাম আহম্মেদ চৌধুরী তাকে যশোরে নিয়ে আসেন। ১৯৬৮ সালে যশোর-খুলনা কাবে তার একক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। জেলা প্রশাসক এনাম আহম্মেদ চৌধূরীর উদ্যোগে ১৯৬৯ সালের ১০ জুলাই মাছিমদিয়ার বাড়িতে দি ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস উদ্বোধন করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শিল্পী জেলার বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে যুদ্ধের ছবি আঁকেন। স্বাধীন দেশের নিজ শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। সে সময় প্রতিদিন রাতে শহরের বিভিন্ন বাড়িতে একটা ঝোলা ব্যাগ কাঁধে তিনি কাটিয়েছেন । তার ব্যাগে  একগাদা আড়বাঁশির সাথে থাকত সাপ, কখনো বেজী।

পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে সুলতান কাছ থেকে দেখেছেন এ দেশের মানুষ, প্রকৃতি, মানুষের জীবনাচার। আর নিজের বোধ ও মেধাকে শাণিত করেছেন আবেগ, অনুভূতি ও উপলব্ধির মাধ্যমে। এরই ফল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে তার ছবি আকার ধরনেও পরিবর্তন আসে। বাংলার কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষকে তিনি নতুন রূপ ও শক্তিতে হাজির করেন তার ছবিতে।   ১৯৭৬ সালে ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমীতে তার একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। মূলত এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে এ দেশের সাংস্কৃতিক এলিটদের সাথে তার নতুনভাবে পরিচয় ঘটে। একে একে বিভিন্ন স্বীকৃতি ও পুরস্কার অর্জন করতে থাকেন তিনি।

১৯৮২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিল্পীকে ম্যান অব এচিভমেন্ট সম্মান, পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় একুশে পদক, চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা, বাংলাদেশ সরকারের আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্স এবং স্বাধীনতা পদক লাভ করেন তিনি। ৭০ বছরের বোহেমিয়ান জীবনে তিনি তুলির আঁচড়ে দেশ, মাটি, মাটির গন্ধ আর ঘামে ভেজা মেহনতি মানুষের সাথে নিজেকে একাকার করে সৃষ্টি করেছেন বিখ্যাত সব ছবি।

সুলতানের আজীবনের লালিত স্বপ্ন ছিল শিশুদের নিয়ে। তাই তিনি শিশুদের জন্য নির্মাণ করেন শিশুস্বর্গ। তিনি নিজের সঞ্চিত অর্থে শহরের মাছিমদিয়া এলাকায় চিত্রা নদীর পাড়ে নিজ বাড়িতে শিশুস্বর্গ নামের বিশাল আকৃতির এক নৌকা নির্মাণ শুরু করেন। উদ্দেশ্য এই নৌকায় করে কোমলমতি শিশুরা প্রকৃতির ছবি আঁকতে আঁকতে সুন্দরবন যাবে । কিন্তু তার সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর নড়াইলবাসীর দাবিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সুলতানের বসতবাড়ি সংলগ্ন ২ একর ৫৭ শতক জমিতে ২০০১ সালের জুলাই মাসে শিশুস্বর্গের আদলে সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা নির্মাণ শুরু হয়। ২০০৩ সালের জুলাই মাসে নির্মাণকাজ শেষ হয়। বর্তমানে সপ্তাহের প্রতিদিন সুলতান সংগ্রহশালা দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা প্রকল্পের অবকাঠামোগুলোর মধ্যে রয়েছে আর্ট গ্যালারি ভবন, শিশুস্বর্গ ও অডিটোরিয়াম ভবন, সংগ্রহশালা, প্রধান ফটক, শিল্পীর মাজার, শিশুস্বর্গ নৌকা ইত্যাদি। প্রতি বছর শিল্পীর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে থাকে নানা আয়োজন।


বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২৩০৫, আগস্ট ০৯, ২০১০


বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।