ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

ভাষাসংগ্রামীদের সমাবেশ : ১১ দফা দাবি

তোফাজ্জল লিটন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১, ২০১০
ভাষাসংগ্রামীদের সমাবেশ : ১১ দফা দাবি

একুশে চেতনা পরিষদ আয়োজিত দুই দিনের ভাষাসংগ্রামীদের সমাবেশ শেষ হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শপথ ও ১১ দফা দাবি উত্থাপনের মধ্য দিয়ে। এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় ৩০ ও ৩১ জুলাই শিল্পকলা একাডেমীতে।




৩০ জুলাই সকালে শিল্পকলা একাডেমীর সঙ্গীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে এই সমাবেশের উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি ও উদ্বোধক ভাষাসৈনিক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেন, বাংলাভাষা পৃথিবীর একমাত্র ভাষা, যে ভাষায় কথা বলতে রক্তপাত ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণে এই ভাষা আজ আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেয়েছে। এই ভাষাকে আন্তর্জাতিক করে তুলতে হলে আগে নিজেদের শুদ্ধ করতে হবে। বাঙালিদেরই আগে বাংলার প্রতি গভীর ভালবাসা দেখাতে হবে। তিনি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরে আরো বলেন, একুশ ও একাত্তরের চেতনা বাঙালির প্রাণের দাবি।

একুশে চেতনা পরিষদের সভাপতি আহমদ রফিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনপর্বে আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান, পরিষদের সহ-সভাপতি বিচারপতি গোলাম রব্বানী, সাধারণ সম্পাদক ও শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক কামাল লোহানী, নারী সংগঠক জামিল আক্তার বিনু প্রমুখ।
 
প্রথম দিনের দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা ও স্মৃতিচারণ অংশের সভাপতি ছিলেন ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপু এবং রওশন আরা বাচ্চু। সারাদেশ থেকে আসা বয়োবৃদ্ধ ভাষাসৈনিকদের অনেকেই ছিলেন দুর্বল ও ক্ষীণকণ্ঠী। অনেকে শয্যাশায়ী বলে আসতে না পারলেও পত্র পাঠিয়েছেন সমাবেশে পাঠের জন্য। ভাষাসৈনিক সরদার ফজলুল করিম ঢাকায় অবস্থান করেও অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। তার চিকিৎসার সুব্যবস্থা হচ্ছে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বরিশাল থেকে আগত ভাষাসৈনিক আজহারউদ্দিন।


আলোচনায় অংশ নেন ভাষাসৈনিকরা। তারা বাংলাদেশের রাস্তায় ইংরেজি সাইনবোর্ড ঝোলানোর তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, সরকারের উচিত এই বিষয়ে কঠোর আইন প্রয়োগ করা। একই সাথে সরকারি সব নথিপত্রও বাংলায় করার দাবি জানান তারা।


ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন বলেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ছিল একটা যুদ্ধ। বাঙালির ঐক্যবদ্ধ শক্তির কাছে সেই যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়েছিল পাকিস্তানিরা। আবারও বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
কামাল লোহানী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির পর এবার ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসও বিকৃতি করার চেষ্টা শুরু হয়েছে। এই চেষ্টাকে রুখতে হবে। তিনি আরো জানান, একুশে চেতনা পরিষদ জীবিত ভাষা সৈনিকদের নিয়ে তথ্যচিত্র ও সম্পাদনাগ্রন্থ প্রকাশেরও উদ্যোগ নিয়েছে।


দ্বিতীয় দিন ৩১ জুলাই ভাষাসংগ্রামী রওশন আরা বাচ্চুর সভাপতিত্বে সকাল ১০টায় শুরু হয় ভাষাসংগ্রামীদের স্মৃতিচারণ।
এম আর সিরাজ বলেন ‘তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। একুশের রাতে আমরা চারুকলায় পোস্টার লিখছি , সামনে কী করবো তার পরিকল্পনা করছি, এমন সময় পুলিশ আমাকেসহ ৬৪ জনকে ধরে কারাগারে নিয়ে গেল । অনেককে ধরে নিয়ে শহরের বাইরে ছেড়ে দিল, কারণ কারাগারে এতো মানুষ রাখার জায়গা নেই।

এছাড়া এতে বায়ান্নর রক্তয়ী সংগ্রামের নানা দিকে তুলে ধরেন ভাষাসংগ্রামী সুফী মোতাহার হোসেন, মোশারফ হোসেন আকুঞ্জি, মঈনুদ্দিন মিয়াজী ও সাইফুল ইসলাম।

রাজশাহী থেকে আসা ভাষাসৈনিক সাইদ উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘তখন আমি রাজশাহী কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ঢাকার সাথে যোগসূত্র রেখে আমরা জোর আন্দোলন করি। এখন ভালো লাগছে এ কথা ভেবে যে, দেশের প্রথম শহীদ মিনার আমরাই নির্মাণ করেছিলাম।
 
বরিশাল থেকে আসা একেএম আজহার উদ্দীন জানালেন, দশম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি প্রায় সাড়ে পাঁচশ ছাত্র-জনতার সাথে আন্দোলনে যোগ দেন।

দুপুরে অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে ভাষাশহীদ স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ‘সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন’ শীর্ষক বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ। স্মারক বক্তৃতায় তিনি বলেন, আমরা স্বপ্ন দেখি বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার ঘোষণা করেছেন জাতীয় ভাষানীতি; সর্বস্তরে বাংলাভাষা ব্যবহারের বিধান জারি হয়েছে। সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু হয়েছে। আমরা স্বপ্ন দেখি বাংলা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তিনি বলেন, শুধু স্বপ্ন নয়, বাস্তবায়নের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাতৃভাষা বাংলার জন্য কাজ করতে হবে।

বিকালের পড়ন্ত রোদ চারদিকে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ততণে সবাই উপস্থিত। বায়ান্নর ভাষাসংগ্রামীদের সঙ্গে সেখানে আছেন তরুণ প্রজšে§র ভাষাপ্রেমীরা। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে রচিত হয় বাঙালির রঝরা গৌরবের ইতিহাস, গতকাল সেই শহীদ মিনারে যৌথভাবে শপথ নেন বায়ান্নর ভাষাসংগ্রামী ও নবীন ভাষাপ্রেমীরা। ভাষাসংগ্রামী ডা. আহমদ রফিক শপথ বাক্য পাঠ করান উপস্থিত সবাইকে। তিনি পাঠ করেন, ‘আমরা ভাষাসংগ্রামীরা একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ নতুন প্রজšে§র তারুণ্যশক্তির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। আমাদের প্রত্যাশা এবং দাবি সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের জন্য কাজ করে যাব। ’ শহীদ মিনারে উপস্থিত সবাই তাঁর সঙ্গে তেজোদীপ্ত শপথ নেন।

সভাপতির ভাষণে অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, দেশে অনাবশ্যকভাবে ইংরেজির ব্যবহার হচ্ছে। এর বড় প্রমাণ শহরের দোকানের নামকরণ। এ প্রবণতা উৎকটভাবে ধরা পড়ছে। আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই সর্বেেত্র বাংলার প্রচলন করতে হবে।


অনুষ্ঠানের দ্বিতীয়পর্বে একুশে চেতনা পরিষদের প থেকে উপস্থিত ভাষাসংগ্রামীদের স্মৃতিস্মারক উপহার দেওয়া হয়। আয়োজকেরা জানান, জীবিত ৬০ জন ভাষাসংগ্রামীর জন্য তাঁরা স্মৃতিস্মারক তৈরি করেছেন। অসুস্থতার জন্য যাঁরা অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি, পরিষদ তাদের বাসায় তা পৌঁছে দেবে।

অনুষ্ঠানে ডা. আহমদ রফিকের সভাপতিত্বে মুক্ত আলোচনা হয়। সেখানে একুশে চেতনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কামাল লোহানী সর্বসম্মতিতে তাদের ১১ দফা দাবি উত্থাপন করেন। সর্বস্থরে বাংলার প্রচলনসহ তাঁদের অন্যন্য দাবির মধ্যে আছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মৌলিক নকশা বাস্তবায়ন, সর্বপ্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবির প্রস্তাবক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে বাংলা একাডেমী থেকে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত রাস্তার নামকরণ, ভাষা আন্দোলনের তথ্য নির্ভর সঠিক ইতিহাস প্রণয়ন, ভাষাসংগ্রামীদের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি এবং অসচ্ছল ভাষাসংগ্রামীদের রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা প্রদান।

সমাবেশের শেষ পর্বে সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। তাতে একুশের গান, গণসংগীত ও একুশের কবিতা আবৃত্তি করেন আমন্ত্রিত শিল্পীরা।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১০৫০, আগস্ট ০১, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।