ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

১৬ বছর ধরে বাইক্কা বিলে বালিহাঁসের প্রজননসাক্ষী কাঠের বাক্স

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০২২
১৬ বছর ধরে বাইক্কা বিলে বালিহাঁসের প্রজননসাক্ষী কাঠের বাক্স বাইক্কা বিলে কাঠের বাক্সের ডিমে তা দিচ্ছে বালিহাঁস। ছবি: বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

মৌলভীবাজার: কাঠের বাক্সের ছোট ছোট ঘর। গাছের গায়ে গায়ে বাঁধা।

দূর থেকে দেখলে মনে হয় হিজল-তমাল গাছের শরীরের সাথে যেন লেপ্টে আছে। যদিও কৃত্রিম অর্থাৎ এসব মানুষের বানানো, তবু এই সুখকর দৃশ্যটি এক থেকে দুই বছরের নয়। গুণে গুণে ১৬টি বছরের! বালিহাঁসদের সার্থক প্রজননসাক্ষী কাঠের সেই কৃত্রিম বাক্সগুলো।

নানা ঘটনাপ্রবাহ পেরিয়ে প্রতি বছরের মতো এবারও এই বর্ষা মৌসুমের শেষ দিনগুলোতে ডিমে তা দিয়ে ছানা ফুটিয়েছে ধলা-বালিহাঁস (Cotton Pygmy-goose)। এভাবেই বাইক্কা বিলের জলাভূমিময় প্রকৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে মানুষ বানানো নির্মিত ওই জীববৈচিত্র্যরক্ষামূলক মহতী উদ্যোগে। প্রতিবছরই সেসব বাক্সগুলোকে পুনঃসংস্কার এবং পুনঃস্থাপন করা হচ্ছে।  

বাক্সগুলো এমন সঠিকমাপে তৈরি করা যাতে, বালিহাঁসের ছানাগুলো শারীরিকভাবে শক্তপোক্ত হয়ে বাক্স থেকে বের হয়ে সহজে বিলের পানিতে লাফিয়ে পড়তে পারে।  

বাইক্কা বিলে বহুদিনের অধিবাসী এ ধলা-বালিহাঁসগুলো। এদের ইংরেজি নাম Cotton Pygmy-goose এবং বৈজ্ঞানিক নাম Nettapus coromandelianus। এরা আকারে আমাদের গৃহপালিত হাঁসের মতোই। প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৩০ থেকে ৩৭ সেন্টিমিটার। দেহের রং অনেকটাই সাদা-কালো। বালিহাঁসের ডিম।  ছবি: বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপনসেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিজ (সিএনআরএস) প্রতিবেশ কার্যক্রমের হাইল হাওর সাইটের সাইট অফিসার মো. মনিরুজ্জামান চৌধুরী বাংলানিউজকে জানান, এ বছর সাতটি কাঠের বাক্সে বালিহাঁস ডিম দিয়েছে। সর্বোচ্চ একটি বাক্সে ১৫টি এবং সর্বনিম্ন ১০টি ডিম দেখতে পাওয়া গেছে। আমাদের টিম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেছে।  যাতে বালিহাঁসগুলো কোনো ধরনের ভয়ভীতি ছাড়া নির্ভয়ে ডিম দিতে পারে এবং ছানা ফোটাতে পারে। ইতোমধ্যে প্রায় সবগুলো বাক্সেই ছানা ফুটিয়েছে বালিহাঁসগুলো।  

‘দেশের ইতিহাসে প্রথম’ ঘটনা উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, বাইক্কা বিলে স্থাপিত কৃত্রিম কাঠের বাক্সে দেশের ইতিহাসে প্রথম বালিহাঁস ডিম দেওয়ার ঘটনা। আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে প্রকৃতির এই উপকারী সম্পদগুলোকে রক্ষা করতে। বাইক্কা বিল মৎস্য অভয়াশ্রমের পাশাপাশি পাখিদের নিরাপদ আবাস স্থল ও প্রজননের অংশ হিসেবে ২২টি কাঠের বাক্স নির্মাণ করা হয় এবং বালিহাঁসের ডিম দেওয়ার সুবিধাজনক স্থানে তা স্থাপন করা হয়।  

তিনি আরও বলেন, সিএনআরএস কর্তৃক ২০০৬ সালে বাইক্কা বিলে প্রথম কাঠের বাক্সে স্থাপন করা হয়। ২০০৭ সাল থেকে বালিহাঁস ডিম দেওয়া শুরু করে। ওই বছরে প্রথম বালিহাঁস ডিম দিয়ে ছানা ফুটিয়ে নিয়ে নির্ভয়ে বাইক্কা বিলে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে বেঁচে নেয়। বালিহাঁস মূলত নিরাপদ স্থানে গাছের কোটোরে/গর্তে ডিম পারে। যেখানে পানির উৎস থাকে এবং বালিহাঁসের ছানাগুলো সহজে চলাচল করতে পারে।  

গাছের সাথে কাঠের ওই বাক্সগুলো বাঁধার প্রক্রিয়ার বিষয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, বাইক্কা বিলের পাড়ে হিজল, করচ, জারুল, বট, শিমুল, জাম প্রভৃতি গাছগাছালির বনায়নের মাঝে স্থাপন করা হয় আরসিসি পিলার এবং বাঁশ বা গাছের খুঁটি। এই পিলারে স্থাপন করা হয় ২২টি কাঠের তৈরি বাক্স যা বালিহাঁসের জন্য ডিম পাড়ার উপযুক্ত স্থান। ২০২২ সালে ২২টি কাঠের বাক্স স্থাপন করা হয় পিলারে এবং বাঁশ কিংবা গাছের খুঁটির সাথে। হিজলতমাল বনে স্থাপিত কাঠের বাক্স।  ছবি: বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপনবাইক্কা বিলের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে তিনি বলেন, স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ও মৎস্য অধিদপ্তরের সহযোগিতায় এবং ইউএসএআইডি এর সাহায্যপুষ্ট বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থায়নে হাইল হাওরের মাছের উৎপাদান ও প্রজাতি বৈচিত্র্য বৃদ্ধি, জলাভূমির সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কাজে ভূমিকা রাখছে।  

সিএনআরএস সূত্র জানায়, হাইল হাওরের সরকার ঘোষিত স্থায়ী মৎস্য অভয়াশ্রম বাইক্কা বিলের ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত বড়গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন (আরএমও)। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত অভয়াশ্রমটি হাইল হাওরে মাছের উৎপাদন ও প্রজাতি বৈচিত্র্য এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে সিএনআরএস কর্তৃক বাস্তবায়িত USAID Eosystems/Protibesh activity হাইল হাওরের প্রতিবেশ উন্নত সংরক্ষণের লক্ষ্যে কাজ করছে।

ইউএসএইড ইকোসিস্টেমস/প্রতিবেশ কার্যক্রমের হাইল হাওর সাইটের মনিটরিং টিম (পর্যবেক্ষক দল) নিয়মিত পাখির বাক্সগুলো মনিটর (পর্যবেক্ষণ) করে চলেছে বলে জানান মো. মনিরুজ্জামান চৌধুরী।  

বাংলাদেশ সময়: ১১৫১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০২২
বিবিবি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।