ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

বিনোদন

অযত্ন-অবহেলায় তারেক মাসুদের বাড়ির বেহাল দশা

হারুন-অর-রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২২
অযত্ন-অবহেলায় তারেক মাসুদের বাড়ির বেহাল দশা

ফরিদপুর: আবু তারেক মাসুদ। যিনি চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ নামেই দেশ-বিদেশে পরিচিত।

১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নুরপুরে জন্ম নেন এই খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার।

প্রখ্যাত এই চলচ্চিত্র নির্মাতা ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের জোকায় এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। ‘কাগজের ফুল’ সিনেমার শুটিং লোকেশন দেখে ঢাকায় ফেরার পথে এই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে।  

এ সময় সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ মাইক্রোবাসে থাকা আরও তিনজন চলচ্চিত্রকর্মী মারা যান। ওই তিনজন হলেন গাড়ির চালক মুস্তাফিজ, তারেক মাসুদের প্রোডাকশন ম্যানেজার ওয়াসিম ও কর্মী জামাল।

নিহতের সেই বছরেই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের দাবির মুখে ও সরকারের আশ্বাসে তারেক মাসুদের নূরপুরের গ্রামের বাড়িসহ কয়েক একর জমি সরকারের ট্রাস্টে দিলেও হয়নি কোনো স্থাপনা। অযত্নে-অবহেলা ও অনাদরে আজও পড়ে আছে তারেক মাসুদের বাড়িটি। নিহতের প্রায় একযুগ কেটে গেলেও কোনো স্থাপনা নির্মাণ না হওয়ায় হতাশ তারেক মাসুদের পরিবারসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।  

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অযত্নে বাড়িটির আঙিনায় ঘাসপাতা জন্মেছে। দর্শনার্থীদের জন্য নেই কোনো বসার বেঞ্চ কিংবা রেস্ট হাউজ। প্রতিদিন শতশত মানুষ এই চলচ্চিত্রকারের বাড়ি দেখতে আসছেন। কিন্তু, তাদের জন্য নেই কোনো শৌচাগার; এতে দর্শনার্থীরা পড়ছেন নানা বিড়ম্বনায়। এছাড়া তারেক মাসুদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও বিভিন্ন সময়ে তার তোলা ছবিগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তারেক মাসুদ ভক্তরা বাড়িটি দেখতে এসে এমন পরিবেশ দেখে নিরাশ হয়েই ফিরছেন।

এসময় কথা হয় তারেক মাসুদের সেঁজো ভাইয়ের বউ সম্পা মাসুদের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ২০১১ সালে তারেক মাসুদ মারা যাওয়ার পরে সরকারের আশ্বাসে ট্রাস্টে দেওয়া হয়েছে পুরো বাড়িটি। কিন্তু স্থানীয় রাজনীতি ও অদৃশ্য কিছু কারণে তারেক মাসুদের মৃত্যুর প্রায় এক যুগ পেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও এর দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।  

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ায় ও ভাঙ্গা গোলচত্বরের পাশে এ বাড়িটি হওয়ায় প্রতিদিনই শতশত মানুষ বাড়িটি ও তার (তারেক মাসুদ) সমাধি দেখতে ভিড় জমায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এখানে দর্শনার্থীদের জন্য একটি শৌচাগারের কিংবা বসার বেঞ্চের মতো জরুরি বিষয়গুলোর দিকেও কর্তৃপক্ষ নজর নেই।

তারেক মাসুদের ভাই মাসুদ বাবু বাংলানিউজকে বলেন, আমরা সরকারের আশ্বাসে পুরো বাড়িটি সরকারের ট্রাস্টে লিখে দেই। সরকার এখানে তারেক মাসুদের সংগ্রহশালা, মিউজিয়াম, গবেষণাগার, লাইব্রেরি, রেস্ট হাউজ, পিকনিক কর্ণারসহ নানা উদ্যোগ হাতে নিয়েছিল। আর এগুলো বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে চিঠি পর্যন্ত এসেছিল। কিন্তু, ভাঙ্গার কিছু রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও অদৃশ্য কিছু কারণে এখন পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি।

প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে মাসুদ বাবু বলেন, সরকার কত জায়গা কত উদ্যোগ নিয়েছেন; কিন্তু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এমন একজন চলচ্চিত্রকারের বাড়ি কিংবা তার স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ আজও অনাদরেই পড়ে আছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি বিষয়টি দেখার জন্য।  

তারেক মাসুদের মা নুরুন নাহার মাসুদ (৮০) বাংলানিউজকে বলেন, আমার তারেক মাসুদ সরকারের অনুদান ছাড়াই ‘মাটির ময়না’ ‘মুক্তির কথা’সহ বেশকিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। সরকার ও দেশের জন্য কাজ করলেও সরকারের কোনো সুযোগ সুবিধাই কখনো নেননি। আজ তার (তারেক মাসুদ) স্মৃতিগুলো নষ্ট হয়ে ও হারিয়ে যাচ্ছে। তাই সরকারের কাছে আমার একটাই দাবি আমার ছেলেটার স্মৃতিটা যেন সরকার বাঁচিয়ে রাখে। আমি মরার আগে যেন এই ট্রাস্টের বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারি।

এ ব্যাপারে তারেক মাসুদের ছোট ভাই নাহিদ মাসুদ বাংলানিউজকে বলেন, সরকারের আশ্বাস ও নির্দেশে আমাদের বাড়িটি ট্রাস্ট্রে লিখে দেওয়ার পরও কেন যে এখানকার কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। বিষয়টি আমাদের ও তারেক মাসুদের অনুরাগীদের জন্য সেটা কষ্টদায়ক।

ভাঙ্গা জর্জ আদালতের আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও প্রবীণ আইনজীবী ইকরাম আলী শিকদার বাংলানিউজকে বলেন, আসলে সবাই আমরা বিষয়টি অনুভব করি। কিন্তু সচিবালয় ও মন্ত্রণালয়ে তদবিরের অভাবে হয়তো কাজটা আগাচ্ছে না। যদি কালচার ডিপার্টমেন্ট একটু আন্তরিক হয় তাহলে কাজটি ত্বরান্বিত হতো।

তারেক মাসুদ ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ক ও ভাংগা কে.এম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোসায়েদ হোসেন ঢালী বাংলানিউজকে বলেন, ভাঙ্গায় তারেক মাসুদ কমপ্লেক্স নির্মাণ করা জরুরি। এ কমপ্লেক্সে লাইব্রেরি থাকবে, চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। তবে, এখানকার রাজনৈতিক ব্যক্তিদের গাফলতির কারণে এখনও আলোর মুখ দেখেনি সরকারের ট্রাস্টে দেওয়া এ বাড়িটির কোনো কাজ।

তিনি বলেন, আমরা এখানকার রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গদের এ ব্যাপারে বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা সত্ত্বেও তারা কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এমন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকারের ব্যাপারটি এড়িয়ে যাওয়া সত্যিই বড় কষ্টদায়ক। এছাড়া তারেক মাসুদের বাড়ির পাশে একটি ম্যুরাল তৈরি করার জন্য এখানকার পৌরসভার মেয়রকে বলা হলেও তিনি আগ্রহ দেখাননি।

ভাঙ্গা নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সুবাস চন্দ্র মন্ডল বাংলানিউজকে বলেন, তারেক মাসুদ ভাঙ্গার সন্তান; তবে বাংলাদেশের গর্ব। ভাঙ্গায় তারেক মাসুদের বাড়িতে তার স্মৃতি রক্ষার্থে কিছু হোক এটা আমাদের সবার চাওয়া। কিন্তু, আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে বারবার বলার পরও কোনো কাজের কাজ হচ্ছে না।

এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে ভাঙ্গা পৌরসভার পৌর মেয়র আবু ফয়েজ মো. রেজার মোবাইলফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।  

তবে এ ব্যাপারে ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আজিম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, চলতি বছরের ১৩ আগস্টে তারেক মাসুদের মৃত্যুবার্ষিকীতে তারেক মাসুদ ফাউন্ডেশনকে উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা উদ্যোগ নিয়ে আর যোগাযোগ করেনি। তবে, এ সংক্রান্ত ব্যাপারে শিগগিরই উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ করে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়কে চিঠি লিখব।

প্রসঙ্গত, দেশের চলচ্চিত্র জগতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র তারেক মাসুদ ১৯৮২ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শেষ করে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন করেন। চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে ১৯৮৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আদম সুরত’ নামের প্রামাণ্যচিত্র। এরপর বেশ কিছু ডকুমেন্টারি, অ্যানিমেশন ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ১৯৯৫ সালে তার নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’ ও ১৯৯৬ সালে ‘মুক্তির কথা’ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয়।  

তারেক মাসুদ ২০০২ সালে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মাটির ময়না’ নির্মাণ করেন। এটি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবসহ কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। সিনেমাটির জন্য কানে ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট লাভ করেন এই নির্মাতা। সিনেমাটির জন্য ২৭তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার লাভ করেন তারেক মাসুদ। এছাড়া অস্কারের বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র শাখায় নিবেদন করা দ্বিতীয় বাংলাদেশী চলচ্চিত্র এটি। এর আগে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ নামের সিনেমা অস্কারে প্রদর্শিত হয়।

তার পরবর্তী সিনেমা ‘অন্তর্যাত্রা’ (২০০৬) ‘রানওয়ে’ (২০১০) সালে মুক্তি পায়। তারেক মাসুদ আমৃত্যু সিনেমা দিয়ে মানুষের মধ্যে আলো ছড়িয়ে গেছেন। নিজ ২০১২ সালে (মরণোত্তর) একুশে পদকে ভূষিত করা হয় এই নির্মাতাকে।

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২২
এনএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।