ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

নির্বাচন ও ইসি

‘ভুট আইলে খবর, নাইলে আমরার খবর নাই’

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৪৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৮
‘ভুট আইলে খবর, নাইলে আমরার খবর নাই’ মণিপুরীপাড়া বস্তির কয়েকজন নারী। ছবি: বাংলানিউজ

সিলেট ঘুরে: প্রদীপের নিচে অন্ধকার। এ প্রবাদ বাক্যটিকেই সত্য করে নিয়তী সর্বদা মুচকি হাসি হেসে যায় মণিপুরীপাড়া বস্তিতে। যার পাশেই আম্বরখানার আলো ঝলমলে বিশাল মার্কেট। সেখানে কত রুশনাই, কত কী যে আয়োজন! অথচ যার ছিঁটেফোটাও নেই, একেবারেই কিচ্ছু নেই বস্তিবাসীদের জীবনে।

ঘরে চাল নেই, আলো নেই, পর্যাপ্ত পানি নেই, বিধবাদের ভাতা নেই, বয়স্কদের বাঁচার সহায়তা নেই, শিক্ষার্থীদের সুবিধা নেই। এখানে কেবল নেই আর নেই।

যেন নেইগুলোই আছে। সিটি করপোরেশনের আওতায় হওয়ায় বস্তিবাসীদেরও কিছু মানবাধিকার অক্ষুণ্ন থাকার কথা ছিল। কিন্তু কিছুই হয়নি।
 
নাগরিক সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফি-বছর ভোট চাইতে আসেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। তাদের নানা সুযোগ-সুবিধার আশ্বাস দিয়েই বছর বছর জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচনী বৈতরণী পার হন। কিন্তু ছিন্নমূল বস্তিবাসীরা থেকে যান উন্নয়নের বাইরে। ঘুরে ফিরে আবার আসে ভোট। তখনই হিসাবে কষতে থাকেন এর বাইরে থাকা এসব মানুষ। সিলেট সিটি করপোরেশনের বস্তিবাসী, নিম্ন আয়ের মানুষদের এটাই প্রকৃত চিত্র।
 
আম্বরখানা কলোনিতে গিয়ে জানা গেল, সেখানে ১২০ পরিবারের বসবাস। টয়লেট মাত্র নয়টি এবং সুপেয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা এক স্থান থেকেই। কলোনির বাসিন্দারা চাঁদা তুলে নিজেরাই এসব ব্যবস্থা করেছেন। ওদিকে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলররা কোনো খোঁজ খবর রাখেন না। তাদের খবর হয় ভোটের সময় এলে।
 
৩০ জুলাই সিসিক নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। প্রার্থীরা নানা প্রতিশ্রুতি নিয়ে এবারও দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। তবে ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা কেবল আগের প্রতিশ্রুতির কথাই মিলিয়ে দেখছেন।
 
কলোনির বাসিন্দা নাজমা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ‘ভুট আইলে খবর, নাইলে আমরার খবর নাই। ভুটও শ্যাষ আমারার খবর নেয়াও শ্যাষ। মেয়র ফাঁচ (পাঁচ) বছর আগে আমরার খবর লইচলা (নিয়েছিলেন)। এখন আর খেউ আইননা (আসেনা)। আমরা মরলেও কেউ খবর লইননা। ’
 
সিলেট সিটিতে কলোনি ও বস্তির সংখ্যা ৫০০টি। সিলেটে মোট ৫ লাখ মানুষের বসবাস। এরমধ্যে কলোনি ও বস্তিতে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজারের মতো মানুষের বসবাস। এখানকার বস্তিগুলো ঢাকার মতো সরকারি জায়গায় গড়ে উঠেনি। ব্যক্তি মালিকানায় বিভিন্ন স্থানে এগুলো গড়ে উঠেছে। আম্বরখানা, শিবগঞ্জ, ছড়ারপাড়, মাছিমপুর, শেখঘাট, লামাপাড়, নবাবরোড, পাঠানতলা, দিঘীরপাড় এবং বেগমপাড়ায় কলোনি ও বস্তিগুলো গড়ে উঠেছে। এখানকার বাসিন্দাদের পুরুষরা দিনমজুর খাটেন। আর নারীরা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। মণিপুরীপাড়া বস্তির নোংরা পরিবেশে খেলছে শিশুরা।  ছবি: বাংলানিউজ
 
করপোরেশন থেকে তেমন সহায়তা করা হয় না বলে কিছুটা এগিয়ে এসেছে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি, ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম-ইউএনডিপি। সংস্থাটি বস্তিগুলোতে ১০টি স্কুল গড়ে তুলছে সহায়তা দিয়েছে।

মাছিমপুর বস্তি বাসিন্দা আবুল সিদ্দিক ও মরিয়ম বেগমের ঘরে চার সন্তান। বড় ছেলের বয়স ১৩ বছর এবং ছোট ছেলের বয়স দুই মাস। আবুল সিদ্দিক ঢালাইয়ের কাজ করেন। আর অন্যের বাসা- বাড়িতে বুয়ার কাজ করেন মরিয়ম। কিন্তু একদম ছোট শিশুকে রেখে কাজে যেতে পারেন না তিনি। শুধু আবুলের আয় দিয়ে তাদের সংসার আর চলছে না।
 
বস্তিবাসী জাহানারা খাতুন বলেন, হ্যারা (জনপ্রতিনিধি) ভুটের সময় বলে আল্লাহর অস্তে আমরার ভুট বিক্কা দ্যান, আমরার দেকবাম। ভুটের পরে আর কুনু খবর তাকে না। ’
 
আর মাত্র কয়েকদিন পরেই আবারও নির্বাচিত হচ্ছে নতুন করপোরেশন। আসছেন নতুন মেয়র। কিন্তু তাদের ভাগ্য কী পরিবর্তন হবে, ঘুরে ফিরে এ প্রশ্নই তাদের মনে।
বেশি বস্তি ও কলোনি এলাকা পড়ছে ৫ নং ওয়ার্ডে। এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রেজওয়ান আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, আমার এলাকায় ২৪১ জনকে বয়স্ক ভাতা দেয়া হয়। আমরা আইডি কার্ড দেখে ৬০ ও ৬৫ বছর বয়সের বৃদ্ধকে এ ভাতা দিয়ে থাকি। অনেকের বয়স বাস্তবে ৮০ বছর কিন্তু আইডি কার্ডে দেখায় ৫৫ বছর। এসব বৃদ্ধকে আমরা কিভাবে ভাতা দেবো।

মণিপুরীপাড়া বস্তির কয়েকজন নারী-পুরুষ।  ছবি: বাংলানিউজস্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ও সুপেয় পানি সরবরাহ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, টয়লেটগুলো কলোনির মালিক নির্মাণ করে দেয়। আমাদের নির্মাণ করতে দেয় না। এ সমস্যা সমাধানে আমরা কলোনি মালিকদের নোটিশ দিয়েছি। তবে ৮০ ভাগ কলোনিতে পানির সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। উঁচু এলাকায় কিছু সমস্যা আছে আমরা কাজ করছি।

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার মেয়র পদে ৬ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১২৭ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৬২ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী, সিপিবি-বাসদ’র আবু জাফর, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’র প্রফেসর ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী এহসানুল হক তাহের ও অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের। এহসানুল মাহবুব জুবায়ের মূলত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী। কিন্তু দলটির নিবন্ধন না থাকায়, তার প্রার্থীকে স্বতন্ত্র প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে হচ্ছে। আর ভোটের মাঠ থেকে ইতিমধ্যে সরে দাঁড়িয়েছেন বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী বদরুজ্জামান সেলিম।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৮
এমআইএস/ইইউডি/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।