ঢাকা, শুক্রবার, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৬ জুন ২০২৫, ০৯ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য মার্কিন ভিসাপ্রাপ্তি জটিল হচ্ছে, অস্বীকার দূতাবাসের

সিফাত কবীর, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:০২, জুন ৫, ২০২৫
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য মার্কিন ভিসাপ্রাপ্তি জটিল হচ্ছে, অস্বীকার দূতাবাসের

যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের গন্তব্য। বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার কারণে সেখানে পড়াশোনা অনেকের সফল ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।

 

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস ২০২৪ সালের ১৮ নভেম্বর তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বর্তমানে দেশটির বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১৭,০০০–এরও বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছে। ২০২২–২০২৩ শিক্ষাবর্ষের তুলনায় এই সংখ্যা ২৬ শতাংশ বেড়েছে, যা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

এর ফলে বাংলাদেশ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী পাঠানো দেশের তালিকায় ১৩তম স্থান থেকে ৮ম স্থানে উঠে এসেছে। গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫০ শতাংশের বেশি বেড়ে ২০১৩–২০১৪ শিক্ষাবর্ষের ৪,৮০২ থেকে ২০২৩–২০২৪ শিক্ষাবর্ষে দাঁড়িয়েছে ১৭,০৯৯ জনে।

কিন্তু সম্প্রতি আবেদনকারী শিক্ষার্থী ও অনুমোদিত স্টুডেন্ট কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা হঠাৎ করে বাতিল করা হচ্ছে— যা উচ্চশিক্ষার সুযোগকে বাধাগ্রস্ত করছে।

সোমবার (২ জুন) যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশিসহ সব আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীকে সতর্ক করেছে। তারা বলেছে, যদি ভিসার নিয়ম না মানা হয়, তাহলে ভিসা বাতিল হতে পারে। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে কিছু কর্মকাণ্ডের তালিকা দিয়েছে, যেগুলো করলে শিক্ষার্থী ভিসা বাতিল হতে পারে।

কোনো শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকলে, পড়াশোনা ছেড়ে দিলে, অথবা তার প্রতিষ্ঠানকে না জানিয়ে প্রোগ্রাম থেকে বেরিয়ে গেলে তার ভিসা বাতিল হতে পারে এবং ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার যোগ্যতাও তিনি হারাতে পারেন বলে বার্তায় জানায় হয়েছে। দূতাবাস শিক্ষার্থীদের প্রতি ভিসার শর্ত মেনে চলতে অনুরোধ জানিয়েছে এবং শিক্ষার্থী হিসেবে অবস্থান বজায় রাখুন যেন কোনো সমস্যা না হয়।

বাংলানিউজ জানতে চেয়েছিল—বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিলের কোনো ঘটনার খবর কি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আছে কি না, বা এ বিষয়ে কোনো তথ্য আছে কি না। জবাবে দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তা  আশা সি বেহ বলেন, একক কারো ভিসা সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এই সতর্কবার্তা এসেছে এমন এক সময়ে, যখন বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের আচরণ, উপস্থিতি ও একাডেমিক নিয়ম মানা নিয়ে কড়াকড়ি নজরদারি চালাচ্ছে দেশটি। নিয়ম না মানলে ভবিষ্যতে মার্কিন ভিসা পাওয়ার সুযোগও নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে সতর্ক করেছে দূতাবাস।

এ বিষয়ে ভিসা পয়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সিইও ও আইন উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন (পান্না) বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বর্তমানে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি, তার মধ্যে অন্যতম হলো—আমেরিকান দূতাবাস কর্তৃপক্ষ পূর্বনির্ধারিত ভিসা সাক্ষাৎকারের তারিখ বাতিল করে দিচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আরেকটি বড় সমস্যা হলো নতুন অনলাইন পোর্টাল। এটি একেবারেই ব্যবহারকারী-বান্ধব নয়। প্রায়ই প্রযুক্তিগত ত্রুটি দেখা দেয়, যা প্রক্রিয়া জটিল করে তোলে।  

পান্না বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে এই প্রশাসন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের বিষয়ে সহানুভূতিশীল নয়। এই ধারণাটাও ভিসা প্রক্রিয়ায় এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে ভিসা দেওয়ার হার আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—প্রতি ১০০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র পাঁচজন ভিসা পাচ্ছেন।  

তিনি আরও বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত শিক্ষার্থীদের ভিসার আবেদনও বিনা কারণে বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে। দূতাবাস কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট কোনো কারণ না দেখিয়ে শুধু বলছে, ‘সেকশন ২১৪-বি’র আওতায় আবেদন বাতিল করা হয়েছে। ’ অথচ এই ধারা অনুযায়ী একজন আবেদনকারীকে প্রমাণ করতে হয় যে, তার যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। কিন্তু আবেদনকারীদের বক্তব্য শোনার আগেই অনেক সময় আবেদন বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে।

হায়ার স্টাডি ইউএসএ লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাশরুল হোসেন খান লায়ন বাংলানিউজকে জানান, মার্কিন ভিসা প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বেশ কিছু বড় ধরনের ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে।  

তিনি বলেন, প্রথম সমস্যাটা হলো ৩৫০ ডলারের এসইভিআইএস ফি দেওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক একেবারে ৩০০ ডলারের বেশি পাঠাতে দেয় না। অতিরিক্ত পরিমাণ টাকা পাঠাতে অনুমতির দরকার হয়, যার জন্য অপেক্ষা করতে হয় এক সপ্তাহ থেকে এক মাস পর্যন্ত।

তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয় সমস্যা হলো—কিছু কিছু মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আংশিক টিউশন ফি আগেই পরিশোধ করতে বলে। এই টাকা বাংলাদেশ থেকে পাঠাতে সময় লাগে, ফলে ভর্তি প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়।

লায়ন জানান, বর্তমানে তারিখ সংকট বা ডেট ব্যাকলগ অন্যতম বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘অনেক সময় কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয় আই-২০ ইস্যু করতে দুই থেকে তিন মাস সময় নেয়। এরপর দূতাবাসে সাক্ষাতের তারিখ পেতে শিক্ষার্থীদের প্রায় এক বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ’

লায়ন আরও জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্কিন দূতাবাস তাদের ভিসা প্রক্রিয়ায় নতুন নিয়ম চালু করেছে। এখন থেকে ডিএস (ডিএস-১৬০) ফর্ম ও অ্যাপয়েন্টমেন্ট কনফার্মেশন নম্বর মিল না থাকলে সাক্ষাৎকারের নির্ধারিত তারিখ বাতিল করে দিচ্ছেন দূতাবাস কর্মকর্তারা।

তিনি বলেন, ধরুন একজন শিক্ষার্থীকে যদি ডিএস বা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নম্বর পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে পুরো প্রক্রিয়া আবার নতুন করে শুরু করতে হয়। এক বছরের সব প্রস্তুতি ও সময় যেন এক ঝটকায় নষ্ট হয়ে যায়। এটা এখন শিক্ষার্থীদের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য মার্কিন ভিসার অ্যাপয়েন্টমেন্ট স্লট পেতে যে সমস্যার কথা বলা হচ্ছে, সে বিষয়ে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা আশা সি বেহ বাংলানিউজকে বলেন, আগে থেকে নির্ধারিত কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করা হয়নি। শিক্ষার্থী ও এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের ভিসা আবেদনকারীরা আবেদন করতে পারেন। আবেদনপত্রে সম্পূর্ণ সঠিক তথ্য দিতে হবে। যারা এখনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাননি, তাদের জন্য আমরা নতুন স্লট খোলার ওপর নজর রাখতে পরামর্শ দিচ্ছি।

যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থী ভিসা অনুমোদনের হার কমে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে দূতাবাসের কর্মকর্তা বলেন, ভিসার আবেদনগুলো আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে বিচার করা হয়। যখন কেউ ভিসার জন্য আবেদন করেন, তখন কনস্যুলার অফিসার ওই ব্যক্তির তথ্য দেখে সিদ্ধান্ত নেন তিনি মার্কিন আইনের অধীন সেই ভিসার যোগ্য কি না।

‘প্রতিটি ভিসা অনুমোদনের সিদ্ধান্তই জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সিদ্ধান্ত। ভিসা পাওয়া একটি অধিকার নয়, এটি একটি সুবিধা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া প্রত্যেক সম্ভাব্য যাত্রীর নিরাপত্তা যাচাই-বাছাই বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মাধ্যমে করা হয়। যারা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা বা জনসুরক্ষায় ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে, তাদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়, যা দেশীয় নাগরিকদের সুরক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,’ যোগ করেন আশা সি. বেহ।

দূতাবাসের কর্মকর্তা আরও তথ্যের জন্য ওয়েবসাইটে https://travel.state.gov/content/travel/en/us-visas/study/student-visa.html ভিজিট করার অনুরোধ জানিয়েছেন।

এমএসকে/এসএমএস/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।