লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীর উপকূলীয় উপজেলা রামগতির এক-তৃতীয়াংশের চেয়েও বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই। দীর্ঘদিন ধরে পদগুলো শূন্য থাকায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিয়ে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
অন্যদিকে প্রধান শিক্ষক না থাকায় সহকারী শিক্ষকরা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে মানতে চান না।
উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, রামগতি উপজেলায় ৯৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৩৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। তাদের দায়িত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন সহকারী শিক্ষকরা। অন্যদিকে আগামী ৩০ জুনে আরও পাঁচজন প্রধান শিক্ষক অবসরে চলে যাবেন।
সূত্রে আরও জানা গেছে, প্রধান শিক্ষকের পদগুলো ৬৫ ভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে এবং ৩৫ ভাগ সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণের বিধান রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সরাসরি প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। তাই প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদ পূরণ করা যাচ্ছে না।
উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষক না থাকা বিদ্যালয়গুলো হচ্ছে চর পোড়াগাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ চর আবদুল্লাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর সেভেজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর সেকান্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর নেয়ামত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম বালুর চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধ্য চর আলগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ চর আলগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পূর্ব চর মেহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর গোসাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পূর্ব চর রমিজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর পূর্ব চর আফজল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রঘুনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রামগতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর বড়খেরী এ.এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর বড়খেরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রঘুনাথপুর পল্লী মঙ্গল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর গাজী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধ্য চর আফজল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ চর লক্ষ্মী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পূর্ব চর গাজী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর পশ্চিম রঘুনাথপুর হাজিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর রমিজ দক্ষিণ পশ্চিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধ্য চর নেয়ামত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর আফজল আদর্শপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধ্য চর আফজল (২) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর চর মেহার মাস্টারপাড়া এ কিউ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর পূর্ব চর সীতা মোল্লপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর পূর্ব চর হাসান হোসেন গোলাম রহমানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম উত্তর চর আলগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর মেহার মাষ্টারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পূর্ব চর গোসাই হাজি নুরুল ইসলাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর দরবেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও লোকমান নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এ উপকূলীয় উপজেলার মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন চর আবদুল্যা ইউনিয়নের দক্ষিণ চর আবদুল্যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই প্রধান শিক্ষক। অন্যদিকে সহকারী শিক্ষকেরও সংকট রয়েছে। দুর্গম চরাঞ্চলের কারণে সেখানে শিক্ষকরা যেতে চান না বলে জানান চরের বাসিন্দারা।
উপজেলার কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘুরে দেখা গেছে, সহকারী শিক্ষকরা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। এ কারণে এসব বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি বিদ্যালয় পরিচালনার কাজও ব্যাহত হচ্ছে।
মধ্য চর আফজল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকা সহকারী শিক্ষক মো. আবু সায়েদ বলেন, ১৫ বছর ধরে এ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই। বিগত ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত এ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই।
এর মধ্যে ২০১৬ সালে এক বছরের জন্য প্রধান শিক্ষক এসেছিলেন। তিনিও চলে যান। আমি এ বিদ্যালয়ে ২০১৯ সালে যোগদানের পর থেকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসছি। আমাকে প্রশাসনিক কাজে উপজেলা সদরে প্রায় দিনই দৌড়াতে হয়। ফলে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে পারি না, যোগ করেন আবু সায়েদ।
এ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রধান শিক্ষক না থাকায় পড়ালেখার মানোন্নয়ন ঠিকমতো হচ্ছে না। অন্যদিকে বিদ্যালয় পরিচালনায়ও সমস্যা হচ্ছে।
পূর্ব চর মেহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাফায়েত উল্যাহ বলেন, গত চার বছর ধরে আমি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছি। এজন্য আমাকে দাপ্তরিক কাজে যেতে হয়। মাঝে মধ্যে ট্রেনিং ও ক্লাস্টারসহ বিভিন্ন মিটিংয়েও যেতে হয়। তখন আমি পাঠদান করতে পারি না।
চর গোসাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক মো. নূরনবী বলেন, শহর এলাকায় স্কুলগুলোতে অবসরের কারণে পদ শূন্য হলে অন্য এলাকা থেকে বদলি হয়ে পদ পূরণ হয়। কিন্তু চরাঞ্চলের স্কুলগুলোতে অবসরে যাওয়ার পর পদ শূন্যই থেকে যাচ্ছে। এ কারণে প্রতিবছরই প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য স্কুলের সংখ্যা বাড়ছে।
উত্তর পূর্ব চর আফজল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক মো. কামাল উদ্দিন বলেন, শিক্ষক সংকটের কারণে শিক্ষার্থীদের পাঠদানসহ প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
আ স ম আবদুর রব সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ও বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চর আবদুল্যাহ ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. সাদ্দাম হোসেন জানায়, চরে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। চরের শিশুরা লেখাপড়া করতে চায়। কিন্তু শিক্ষক না থাকায় তেমন একটা পড়ালেখা হয় না। ফলে শিশুরা ঠিকমতো বিদ্যালয়ে যায় না। এতে পড়ালেখা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে।
শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে চরের শিশুদের শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ করে দিতে হবে।
দক্ষিণ চর আবদুল্যাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. রাজীব বলেন, প্রাক প্রাথমিক শ্রেণিতে শিক্ষার্থী রয়েছে ২৯ জন, প্রথম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী রয়েছে ৩০ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে শিক্ষার্থী রয়েছে ৩৭ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে শিক্ষার্থী রয়েছে ৩২ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে রয়েছে ১৯ জন এবং পঞ্চম শ্রেণিতে রয়েছে মাত্র ১২ জন। এর মধ্যে ছাত্র ৬৮ জন এবং ছাত্রী ৯১ জন। এ বিদ্যালয়ে পাঁচজন শিক্ষকের বিপরীতে রয়েছেন মাত্র তিনজন।
চর সেবেজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, এ বিদ্যালয়ে কখনো প্রধান শিক্ষক এসেছিলেন কিনা, তা আমার জানা নেই। চরের এ বিদ্যালয়ে ১৫৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। উপস্থিতি ৬০% থাকলেও নানা কারণে ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা।
উপজেলা সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি আবু সায়েদ বলেন, ৩৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় সহকারী শিক্ষকরা দায়িত্ব পালন করছেন। অনেক ক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের আদেশ-নির্দেশ মানতে চান না অন্য শিক্ষকরা।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, শূন্য পদগুলো পূরণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। শিক্ষকরা পদোন্নতি পেলে দ্রুত পদায়ন করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০২৩
এসআই