ঢাকা, শুক্রবার, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ মে ২০২৪, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

শিক্ষা

‘রাবি’ যেন এক অখণ্ড ইতিহাস

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০২২
‘রাবি’ যেন এক অখণ্ড ইতিহাস

রাজশাহী: দেশের অন্যতম এবং উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠতম বিদ্যাপিঠ হচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।



মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের প্রতিটি অঞ্চলের মতো মতিহারের এই সবুজ চত্বরকেও রক্তে রঞ্জিত করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। ওই সময় রাবির ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মহান মুক্তিযুদ্ধে রেখেছিলেন দূরন্ত এক সাহসী ভূমিকা। আজও তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়া সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করে যাচ্ছে সবুজে ঘেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়।

রাবির প্রবেশমুখ থেকে শুরু করে ভেতর অব্দি এমন কিছু স্থাপনা ও ভাস্কর্য রয়েছে যেগুলো যুগ যুগ ধরে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল বিজয়গাথা। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ই যেন একটা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জিইয়ে রাখা জাদুঘর। যার আভায় জ্বলজ্বল করছে পুরো ইতিহাস।



মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে শহীদদের স্মৃতিকে চির অম্লান করে রাখতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা’ অন্যতম। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হওয়া শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারীদের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে গড়ে উঠেছে দেশের সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক জাদুঘরটি। স্বাধীনতা যুদ্ধের ও ইতিহাসের বিভিন্ন উপকরণ সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এই সংগ্রহশালাটি নির্মাণ করা হয়। ১৯৭৬ সালের ৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই সংগ্রহশালাটি।

সংগ্রহশালাটির প্রবেশমুখে দেখা যাবে উঁচু মঞ্চে দাঁড় করানো মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত সবুজ রঙের একটি বিধ্বস্ত গাড়ি। দৃষ্টিনন্দন একতলাবিশিষ্ট সংগ্রহশালাটির বারান্দায় রয়েছে ৭ মার্চের ভাষণরত বঙ্গবন্ধুর আলোকচিত্র। মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতি দিয়ে সাজানো এই সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে স্বাধীনতাযুদ্ধে শিক্ষক, ছাত্র এবং কর্মচারীদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোকচিত্র, শহীদদের প্রতিকৃতি, কোলাজ, ভাস্কর্য ও বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি। ৬ হাজার ৬০০ বর্গফুট আয়তনের সংগ্রহশালাটিতে আছে মোট ৩টি গ্যালারি। আলাদা গ্যালারিতে সাজানো রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সরঞ্জাম ও বিভিন্ন আলোকচিত্র। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত শহীদের ব্যবহৃত জামা, জুব্বা, কোট, ঘড়ি, পোশাক, টুপি, কলমসহ বিভিন্ন দুর্লভ জিনিস এতে স্থান পেয়েছে।



সংগ্রহশালায় উল্লেখযোগ্য দলিলাদির মধ্যে রয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশিদুল হাসান, সিরাজউদ্দিন হোসেন প্রমুখের রোজনামচা। শিল্পী কামরুল হাসানের অঙ্কিত মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পোস্টার। রয়েছে রাবির গণকবর থেকে প্রাপ্ত নাম না জানা শহীদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র। ঢাকার জগন্নাথ হলের হত্যাকাণ্ড, রায়ের বাজার বধ্যভূমি, ১৯৬৯ সালে রাবির গুলিবদ্ধ শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহার আলোকচিত্র। এখানে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকদের জন্য এটি প্রধান সহায়ক। এখানে তিন হাজারেরও বেশি বই ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকার বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। প্রতি বছর এখানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই সংযোজন করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে শিল্পী নিতুন কুন্ডু নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের স্বারক ভাস্কর্য ‘সাবাস বাংলাদেশ’। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশে যে কয়টি প্রতীকি ভাস্কর্য রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম নান্দনিক ভাস্কর্য এটি। ভাস্কর্যটিতে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার চারটি লাইন স্থান পেয়েছে যা এই ভাস্কর্যটিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে- ‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়। ’



রাবির সিনেট ভবনের দক্ষিণ পাশে এই সাবাস বাংলাদেশ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছে। শিল্পী নিতুন কুন্ডুর শৈল্পিক হাতের সুনিপুণ ছোঁয়ায় লাল বেলে মাটির এই ভাস্কর্যে রচিত হয়েছে সংগ্রামী বাঙালির ইতিহাস এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলার চূড়ান্ত এক বিজয়ের জীবন্ত ছবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের উদ্যোগে ১৯৯১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৯৯২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি এটির উদ্বোধন করেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।

ভাস্কর্যটির পাদদেশে রয়েছে একটি মুক্তমঞ্চ। ৪০ বর্গফুট জায়গার ওপর নির্মিত ভাস্কর্যের ঠিক পেছনেই রয়েছে ৩৬ ফুট লম্বা একটি দেয়াল। দেয়ালটির উপরিভাগে একটি বৃত্ত, যা স্বাধীনতার সূর্যের প্রতীক। ভাস্কর্যটির দুই পাশে রয়েছে আয়তাকার দুটি দেয়াল, যার একটিতে কয়েকজন বাউলগান করছে, যা বাঙালি জাতির গ্রামীণ সংস্কৃতির পরিচায়ক। অন্য দেয়ালটিতে মায়ের কোলে শিশু ও দুই তরুণী, যাদের একজনের হাতে রয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
সেই পতাকার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে এক কিশোর। দুই তরুণ মুক্তিযোদ্ধা। ভাস্কর্যটিতে একজনের পরনে রয়েছে প্যান্ট, অন্যজনের লুঙ্গি। একজন দুই হাত দিয়ে রাইফেল ধরে আছে, আরেকজনের ডান হাতে রাইফেল আর বাঁ হাত মাথার ওপরে মুষ্টিবদ্ধ; যেন বাঙালির হৃদয়ের বিজয় অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ। তারা শত্রুকে শেষ করে দিতে অদম্য গতিতে ছুটছে, যা মুক্তিযুদ্ধে সব পেশার মানুষের অংশগ্রহণের প্রতীক।



রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজোহা হলের মূল ফটকের পাশে পুকুর পাড়ে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘স্ফুলিঙ্গ’। যে স্মৃতিস্তম্ভটি স্মরণ করিয়ে দেয় এক মহান শিক্ষকের আত্মত্যাগের কথা। বাংলাদেশের ইতিহাসে যিনি এক অনন্য নাম শহীদ ড. শামসুজ্জোহা। লাখো, কোটি শিক্ষার্থীর যিনি প্রেরণার উৎস। যিনি নিজ ছাত্রদের রক্ষা করতে পাকসেনাদের বুলেটের সামনে বুক পেতে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। ড. শামসুজ্জোহাকে নিয়ে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ স্ফুলিঙ্গের ভাস্কর্যটির স্থপতি রাবির চারুকলা বিভাগের সাবেক সভাপতি কনক কুমার পাঠক। ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। ১৫ ফুট উচ্চতা, ৩৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২৪ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট এই ভাস্কর্যে শহীদ শামসুজ্জোহার ৩ ফুট উচ্চ আবক্ষ প্রতিকৃতি রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারীসহ আশপাশের লোকজনকে হত্যা করে জোহা হলের পেছেনে মাটিচাপা দেয়। ১৯৭২ সালের ২৩ এপ্রিল আবিষ্কৃত হয় এখানকার গণকবরগুলো। ধারণা করা হয় এই গণকবরগুলোতে প্রায় ৩-৪ হাজার নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে এ স্থানটি সংরক্ষণ করতে সেখানে নির্মিত হয় ‘বধ্যভূমি স্মৃতি স্তম্ভ’। ২০০০ সাল রাবির তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক এম সাইদুর রহমান খান বধ্যভূমির স্মৃতিফলকের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ২০০২ সালে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ড. রেদোয়ান আহমেদ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।


বিশাল এই বধ্যভূমি সমতল ভূমি থেকে ৪২ ফুট উঁচু এবং ৬ স্তর বিশিষ্ট একটি স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। স্তম্ভ ঘিরে একটি কংক্রিটের বেদি এবং বেদির মাঝখানে বড় একটি কূপ। স্তম্ভের গায়ের কালো ছাপ দেশের স্বাধীনতায় অবদান রাখা শহীদদের রক্ত শুকানো দাগের প্রতীক। অন্যদিকে কূপটিকে ‘মৃত্যুকূপ’র সঙ্গে তুলনা করা হয়। স্তম্ভের ভাঙা ইট দ্বারা মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ের ক্ষত বোঝানো হয়েছে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামের তালিকার ফলক।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী জীবন বিলিয়েছিলেন। তাদের জীবনের বিনিময়ে আজকের সুন্দর বাংলাদেশ। শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভগুলো আমাদের সবার জন্য এক অনন্য অনুপ্রেরণার উৎস। এতে পুরো বাঙালি জাতির প্রগাঢ় দেশপ্রেম, পরস্পরের সম্প্রীতি ও একতাবদ্ধতার ছবি অঙ্কিত হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও আপামর মানুষকে স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, বাঙালির ঐতিহ্য মনে করিয়ে দিচ্ছে এ স্মৃতিস্তম্ভগুলো। দেশের জন্য তাদের আত্মদানকে বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্ম কৃতজ্ঞতাচিত্তে স্বরণ করবে এখানে এসে। বলা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মহান মুক্তিযুদ্ধের অখণ্ড ইতিহাস এবং অন্যতম স্মারক। যার পরতে পরতে রয়েছে জানা অজানা সব স্বর্ণালী ইতিহাস।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০২২
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।