ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

নলডাঙ্গায় বন্যায় ক্ষতি ১০১ কোটি টাকা

মামুনুর রশিদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০২০
নলডাঙ্গায় বন্যায় ক্ষতি ১০১ কোটি টাকা

নাটোর: নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলায় এবার তিন দফা বন্যায় কৃষি, মৎস্য, সড়ক ও অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে প্রায় ১০১ কোটি ৬১ লাখ ৮৯ হাজার ৪০০ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১৭ হাজার ১৩৭ জন কৃষক, ১৭৬ জন মৎস্যচাষি ও প্রায় ৩০ হাজার বন্যা দুর্গত মানুষ।

বৃহস্পতিবার (২২ অক্টোবর) জেলার নলডাঙ্গা উপজেলার কৃষি, মৎস্য, এলজিইডি, পিআইও দপ্তর ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এর মধ্যে কৃষিখাতে প্রায় আট কোটি ১৫ লাখ ৮৯ হাজার ৪০০ টাকা, মৎস্য খাতে প্রায় ৫৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, স্থানীয় সরকারের সড়কে ক্ষতি প্রায় ১০ কোটি টাকা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় আট কোটি টাকা এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের ক্ষতি প্রায় ১৫ কোটি টাকা। আর বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে ২০০টি।

নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসার ফৌজিয়া ফেরদৌস বাংলানিউজকে জানান, এবারের তিন ধাপের বন্যায় এ উপজেলায় আট কোটি ১৫ লাখ ৮৯ হাজার ৪০০ টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। প্রথম দফার বন্যায় আবাদকৃত ১৮৫ হেক্টর আউশ ধানের মধ্যে ৪৫ হেক্টর জমির ধান বন্যার পানির নিচে নিমজ্জিত হয়ে আর্থিক ক্ষতি হয় ৫৩ লাখ ১০ হাজার টাকা, আবাদকৃত ১২০ হেক্টর সবজি ক্ষেতের মধ্যে নয় দশমিক ৫০ হেক্টর সম্পূর্ণ পানিতে নিমজ্জিত হয়। তাতে আর্থিক ক্ষতি হয় প্রায় ২৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা আর ২২০ হেক্টর বীজতলার মধ্যে ১৬ হেক্টর বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়ে প্রায় ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রথম দফার বন্যায় ১২ হাজার ৮২৫ জন কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

তিনি বলেন, দ্বিতীয় ধাপের বন্যায় ১৮৫ হেক্টর আউশ ধানের মধ্যে ৮৪ হেক্টর সম্পূর্ণভাবে পানিতে নিমজ্জিত হয়ে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৯৮ লাখ ৬৪ হাজার ৮০০ টাকা। আবাদকৃত ১৭৫ হেক্টর আমনের মধ্যে ৯৬ হেক্টর জমির ধান পানিতে নিমজ্জিত হয়ে ক্ষতি হয় প্রায় ৫৭ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। আর ১২০ হেক্টর সবজি ক্ষেতের মধ্যে ৬২ হেক্টর পানিতে নিমজ্জিত হয়। এতে আর্থিক ক্ষতি দাঁড়ায় প্রায় ১৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা। মোট কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন চার হাজার ৩১২ জন।
 
কৃষি কর্মকর্তা বলেন, শেষ ধাপের বন্যায় আবাদকৃত ২ হাজার ৬১০ হেক্টর পরিমাণ রোপা আমনের মধ্যে ৩৫৬ হেক্টর বন্যার পানিতে সম্পূর্ণভাবে নিমজ্জিত হয়। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় চার কোটি সাত লাখ ২৬ হাজার ৪০০ টাকা। আর আবাদকৃত ২৮৫ হেক্টরের মধ্যে ১০ হেক্টর সবজি ক্ষেত পানিতে তলিয়ে যায়। এতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩৬ লাখ টাকা। আর মোট ক্ষতিগ্রস্ত হন দুই হাজার ৮০৭ জন কৃষক।

তিনি আরও বলেন, কৃষকদের এসব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগামি বোরো ধানের আগেই এসব জমিতে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগাম জাতের, উচ্চ ফলনশীল ও স্বল্পমেয়াদি সরিষার আবাদ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে বারি-৭, বারি-৯, বারি-১৪ ও বারি-১৫ জাতের সরিষা চাষাবাদে কৃষকরা লাভবান হবেন। আর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা যাতে সরকারিভাবে আর্থিক প্রণোদনা সহযোগিতা পায় সে ব্যাপারে একটি তালিকা প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। সরকারিভাবে এসব সহায়তা দেওয়া হলে যথাযথভাবে তা বিতরণ করা হবে।

নলডাঙ্গা উপজেলা মৎস্য অফিসার (চলতি দায়িত্বে) সুজিত কুমার মুন্সি বাংলানিউজকে জানান, এবারের তিন ধাপের বন্যায় এ উপজেলায় মৎস্য খাতে প্রায় ৫৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১৭৬ জন মৎস্যচাষি ও পুকুর বা খামার মালিক। এর মধ্যে ৮৭ দশমিক ৮০ হেক্টর পরিমাণ পুকুর প্লাবিত হয়েছে আর প্রায় নয় কোটি ৩০ লাখ পরিমাণ পোনা মাছ ভেসে গেছে। আর্থিক বিবেচনায় ভেসে যাওয়া মাছের ক্ষতির পরিমাণ ৩৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং ভেসে-যাওয়া পোনা মাছের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় নয় কোটি ৩০ লাখ টাকা। অপরদিকে অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে প্রায় দুই কোটি ৮৬ হাজার টাকা।

মৎস্য অফিসার বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষি ও খামার মালিকদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা হয়েছে। এসব তালিকা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। সরকার তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করলে তা সঠিকভাবে বন্টন করা হবে।   

নলডাঙ্গা উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, বন্যায় এ উপজেলায় পাঁচটি ইউনিয়নের কাঁচা পাকা মিলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১৯ কিলোমিটার সড়ক। এতে আর্থিক মূল্যে মোট ক্ষতি হয়েছে ১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাধনগর ইউনিয়নে কাঁচা ও পাকা মিলে পাঁচ কিলোমিটার সড়কে ক্ষতি হয়েছে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা, খাজুরা ইউনিয়নের চার কিলোমিটার সড়কে ক্ষতি হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা, ব্রহ্মপুর ইউনিয়নে প্রায় চার কিলোমিটার সড়কে ক্ষতি হয়েছে প্রায় দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা, পিপরুল ইউনিয়নে তিন কিলোমিটার সড়কে ক্ষতি হয়েছে এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা ও বিপ্রবেলঘরিয়া ইউনিয়নে পাকা ও কাঁচা সড়ক মিলে তিন কিলোমিটার সড়কে ক্ষতি হয়েছে এক কোটি ৫০ লাখ টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের তালিকা প্রস্তুতসহ সম্ভাব্য ব্যয়ের চাহিদাপত্র সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে দরপত্রের মাধ্যমে এসব সড়ক সংস্কার ও মেরামত করা হবে।  

নলডাঙ্গা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. ওমর খৈয়াম বাংলানিউজকে জানান, এবারের বন্যায় এ উপজেলায় প্রায় ২০০টি মাটির তৈরি ঘর বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। যার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে কয়েক লাখ টাকা। তাদের তালিকা তৈরি করে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু রায়হান বাংলানিউজকে জানান, প্রথম, দ্বিতীয় ও শেষ ধাপের বন্যায় নলডাঙ্গা উপজেলায় প্রায় ১৫ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক বা বাঁধের ক্ষতি হয়েছে। এতে মোট ক্ষতি হয়েছে প্রায় আট কোটি টাকা। মেরামত বা সংস্কার করতে সম্ভাব্য ব্যয় হবে এই টাকা। এজন্য আর্থিক চাহিদা পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে এসব কাজ বাস্তবায়ন করা হবে।

নাটোর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুর রহিম বাংলানিউজকে জানান, এবারের বন্যায় সওজের অধীনে নলডাঙ্গা উপজেলায় প্রায় ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার আর্থিক বিবেচনায় ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। আর সিংড়া ও নলডাঙ্গা এই দুই উপজেলায় প্রায় ৮০ কিলোমিটার সড়কের ক্ষতি হয়েছে। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। তিনি বলেন, এসব মেরামত বা সংস্কার করতে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এজন্য তার দপ্তর থেকে আর্থিক চাহিদা পাঠানো হচ্ছে। বরাদ্দ পেলে সময় মতো কাজ সম্পন্ন করা হবে।

নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলানিউজকে জানান, তার উপজেলায় খাজুরা, পিপরুল ও মাধনগর ইউনিয়নে বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হযেছে। এসব এলাকার প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছিল। তাদের জন্য ২৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছিল এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। সরকার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের চিন্তা ভাবনা করছেন। এজন্য ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। বরাদ্দ পেলে যথা সময়ে তাদের সহায়তা দেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০২০
কেএআর/আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad