ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শেয়ারবাজার

যে পাঁচ কারণে ডিএসই’র মালিকানায় ভারতকে ‘না’ 

মাহফুজুল ইসলাম, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৮
যে পাঁচ কারণে ডিএসই’র মালিকানায় ভারতকে ‘না’  ডিএসই'র লোগো।

ঢাকা: শেয়ারের যোগ্য দাম না পাওয়ায় স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারের খোঁজে গত বছর তৃতীয় দফায় টেন্ডার আহবান করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এতে দু’টি কনসোর্টিয়াম আবেদন করে। একটি হচ্ছে চীনের দুই স্টক এক্সচেঞ্জ সেনজেন ও সাংহাই।

অপর কনসোর্টিয়ামটি হচ্ছে, ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের (এনএসই) সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন লিমিটেড, যুক্তরাষ্ট্রের নাসডাক এবং ফ্রন্টিয়ার বাংলাদেশ।

চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর বোর্ড এ প্রস্তাব দু’টি যাচাই-বাছাই করে।

এরপর ১০ ফেব্রুয়ারি পাঁচটি কারণে ডিএসই’র বোর্ড সবার সম্মতিতে চীনা কনসোর্টিয়ামকে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে অনুমোদন দেয়।  

চীনা কনসোর্টিয়ামকে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে অনুমোদন দেওয়ার পেছনে যে কারণগুলো দেখানো হয়েছে- শেয়ার প্রতি ২২ টাকা দর প্রস্তাব, আইটি খাতের জন্য আলাদা বিনিয়োগের পাশাপাশি বিনামূল্যে কারিগরি সহায়তা প্রদান, দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ, পরিচালক হিসেবে একজন প্রতিনিধি প্রস্তাব এবং ১১ হাজার বিদেশি বিয়োগকারীর সম্ভাবনা।

এ প্রস্তাব সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) ডিএসই’র বোর্ড সভার পর বাংলাদেশ সিকউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।

এ বিষয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে ডিএসই’র একাধিক পরিচালক বাংলানিউজকে বলেন, চীনা কোম্পানির প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্য, পরিপূর্ণ এবং আন্তর্জাতিক মানের। তাই সবদিক বিবেচনা করেই চীনা কনসোর্টিয়ামকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।  

তারা আরও বলেন, চীনা দুই স্টক এক্সচেঞ্জ ডিএসইর শেয়ার কিনলে দেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়বে। আন্তর্জাতিকভাবে দেশীয় পুঁজিবাজারের মর্যাদা বাড়বে।

ডিএসইর তথ্য মতে, চীনা কনসোর্টিয়াম কোনো ধরনের শর্ত ছাড়াই দীর্ঘ মেয়াদে ডিএসইর ২৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানায় আসতে চায়। তারা শেয়ার প্রতি ২২ টাকা দরে ডিএসইর ৯৯২ কোটি ৭ লাখ ৭০ হাজার ৭৫০ টাকার শেয়ার কেনার প্রস্তাব করেছে।

অপরদিকে ভারতীয় কনসোর্টিয়াম ১৫ টাকা দরে মাত্র পাঁচ বছরে জন্য শেয়ার কিনতে চায়, যার মূল্য ৬৭৬ কোটি ৬৮ লাখ ৬৭ হাজার ৫৪৫ টাকা। এরপর প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে এসব শেয়ার বিক্রি করে দিতে চায়। শুধু তাই নয়, ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন আইন ভঙ্গ করে পরিচালক পদে একাধিক ব্যক্তি রাখতে চায় তারা। আইনে বলা হয়েছে, কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে থেকে মাত্র একজন পরিচালক বোর্ডে থাকবেন।

চীনা কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাবে বলা হয়, তাদের দু’টি স্টক এক্সচেঞ্জ ডিএসইর ২৫ শতাংশ শেয়ার কিনবে। অপরদিকে এনএসই স্টক এক্সচেঞ্জ নিজে কিনেছে না। তারা সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন লিমিটেডের মাধ্যমে ২২ দশমিক ০১ শতাংশ এবং ফ্রন্টিয়ার বাংলাদেশের মাধ্যমে ৩ শতাংশ শেয়ার কিনবে বলে প্রস্তাবে উল্লেখ করে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি নাসডাকের কোনো শেয়ার নেই।

এছাড়াও চীনা কোম্পানি ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগকারী হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব অভ্যন্তরীণ এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর অনুমোদন নিয়েছে। অপরদিকে ভারতীয়রা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (সেবি) এবং রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন পায়নি।

অন্যদিকে চীনা প্রতিষ্ঠান দু’টি ডিএসইকে প্রযুক্তিগতভাবে সহায়তা করতে বিনা শর্তে আটটি পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে, ৩৭ দশমিক ১১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ভারতীয় প্রস্তাবে কোনো প্রযুক্তিগত প্ল্যাটফর্ম বা সিস্টেমের কথা উল্লেখ নেই। তা কেবল পরামর্শ এবং অভিজ্ঞতা শেয়ারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য ডিএসইর সঙ্গে নির্দিষ্ট শর্তের ভিত্তিতে একটি ব্যবসায়িক চুক্তি করার কথাও বলা হয়।

ডিএসই’র মালিকানা কেন্দ্র করে যত ঘটনা: প্রস্তাবে হেরে গত ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন এনএসইর প্রধান নির্বাহী বিক্রম লিম। ঢাকায় এসে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ডিএসইর এমডি-চেয়ারম্যান ও দেশের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। যেকোনো মূল্যে তারা ডিএসইর শেয়ার কিনতে চান বলে জানানো হয়।

প্রথম দফায় ডিএসই’র এমডি ও চেয়ারম্যান রাজি না হওয়ায়, বিএসইসি’র মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করেন। এতে বিএসইসি’র চেয়ারম্যান ডিএসইর এমডি ও চেয়ারম্যানকে তলব করেন।

বৈঠকে ডিএসই’র এমডিকে বিভিন্ন ভাষায় গালি ও কটুক্তি করেন বিএসইসি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক খায়রুল হোসেন এবং ভারতের প্রস্তাবটি বিবেচানার জন্য চাপ দেন। কিন্তু সেটিও প্রত্যাখান করেন ডিএসই’র এমডি।

১৩ ফেব্রুয়ারি বিএসইসি’র চেয়ারম্যান ডিএসই’র পরিচালক রকিবুর রহমান এবং ডিএসইর আরেক সদস্যকে কমিশনে ডাকেন। দীর্ঘক্ষণ বৈঠক শেষে তাদেরকে চীন ও ভারতের মধ্যে শেয়ার ভাগবাটোয়ারা করে দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন। কারণ হিসেবে সরকারের উচ্চমহল থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। কিন্তু ডিএসই পরিচালক তার দাবিতে অনড় থাকেন।

ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগকারী বাছাইয়ের পর কমিশনের এই অযথাচিত হস্তক্ষেপের বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এরপর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গত শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়। এর প্রেক্ষিতে বিএসইসিও প্রতিবাদ জানায়।

উল্লেখ্য, ২০১০ সালে পুঁজিবাজার ধসের পর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে ডিএসইর ব্যবস্থাপনা থেকে মালিকানা আলাদা করার জন্য ‘ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন অ্যাক্ট-২০১৩’ গঠন করা হয়। এতে কৌশলগত অংশীদারদের ২৫ শতাংশ শেয়ার বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়। আর সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো বা ব্রোকারেজ মালিকরা স্টক এক্সচেঞ্জের ৪০ শতাংশ শেয়ারের মালিকানায় থাকবেন। বাকি ৩৫ শতাংশ শেয়ার পরবর্তীতে আইপিও’র মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করতে হবে।

পরবর্তী সময়ে কৌশলগত বিনিয়োগকারী নেওয়ার জন্য ২০১৫ সালে ১ বছর সময় দিয়ে চিঠি ইস্যু করে বিএসইসি। পরে ৬ মাস করে আরও দুই দফায় সময় বাড়িয়েছে কমিশন, যা আগামী মার্চ মাসের ৮ তারিখ শেষ হবে।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৮ 
এমএফআই/এনএইচটি

** 
কৌশলগত বিনিয়োগকারী ইস্যুতে দরপতনের বৃত্তে পুঁজিবাজার

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।