ঢাকা: ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঝুঁকি মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বৈষম্যহীন ও টেকসই ভিত্তি নিশ্চিত করায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এবারের বাজেটে প্রথাগত অবকাঠামো থেকে বেরিয়ে মানুষকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।

সোমবার (০২ জুন) বিকালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে দেওয়া ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন।

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে প্রবৃদ্ধির গতি বাড়ানোর পরিবর্তে সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণার ওপর জোর এবং অর্থনীতির ভিত মজবুত করার দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। এ শক্তিশালী ভিতই হবে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের সোপান। আগামীর সেই বাংলাদেশে সবার জন্য মানসম্মত জীবন এবং সব স্তরে বৈষম্যহীন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দেওয়াই হবে আমাদের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য পূরণে আমি সবার সহযোগিতা চাই।

তিনি বলেন, মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, জীবিকার নিরাপত্তা ও বৈষম্যহীন পরিবেশে অত্যাবশ্যক উপাদানগুলো ছাড়া যে কোনো রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে পড়ে, দুর্বল হয় সমাজের ভিত। এবারের বাজেটে তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নাগরিক সুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমাগত যেসব সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, তার সুবিধা ভোগ এবং যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে, তা মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার দিকেও মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনে একটি উন্নত সমাজ বিনির্মাণের জন্য আমরা যেসব কার্যক্রম হাতে নিয়েছি, এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে-শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বনভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ-যার মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন হবে এ দেশের মানুষের জীবনমানের এবং মুক্তি মিলবে বৈষম্যের দুষ্টচক্র থেকে।

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে তিনি বলেন, ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। আমাদের ওপর বর্তায় বিগত সরকারের রেখে যাওয়া প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার এবং নৈরাজ্য দূর করে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার কঠিন কাজটি। আমি স্বস্তি এবং আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই, মাত্র ১০ মাসেরও কম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার সে লক্ষ্য পূরণে অনেকদূর এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।

তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ভেঙে পড়া আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, শ্রমিক অসন্তোষ প্রশমিত করে শিল্প খাতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং বিগত সরকারের সময়ে লাগামহীন দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ফলে চরম সংকটাপন্ন ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের মতো কঠিন চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবিলা করতে হয়েছে। শুরু থেকেই আমরা সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে চেষ্টা করেছি এসব সমস্যার সমাধান করে দেশকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। প্রবাস আয়ের আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি, রপ্তানি আয়ের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, কৃষি ও শিল্প খাতের উৎপাদন অব্যাহত থাকা এবং সঠিক মুদ্রা ও রাজস্বনীতির সমন্বিত প্রয়োগের সুফল হিসেবে আমরা কাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীলতা অর্জনে অনেকদূর এগিয়েছি।

তিনি বলেন, বিগত সরকারের রেখে যাওয়া সংকটাপন্ন অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয়ে গঠিত টাস্কফোর্স থেকে এবং দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয়ে শ্বেতপত্র কমিটি থেকে সুপারিশ পাওয়া গেছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং পরবর্তী অধ্যায়ে বিবৃত খাতভিত্তিক অগ্রাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ সব সুপারিশ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
ড. সালেহউদ্দিন বলেন, মাত্র অল্প কয়েক মাসে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশকে স্থিতিশীল করার কাজটি প্রায় সম্পন্ন করে আনা সম্ভব হলেও পরিপূর্ণ সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে আমাদের এখনও অনেকটা পথ পেরোতে হবে। পরিপূর্ণ স্থিতিশীলতা অর্জন করে অর্থনীতিকে স্বাভাবিক গতিতে ফিরিয়ে আনার পথে এখনো বেশ কিছু ঝুঁকি রয়েছে। গত এপ্রিলে মার্কিন প্রশাসনের আরোপ করা অতিরিক্ত শুল্কের নেতিবাচক প্রভাব আমাদের অর্থনীতির ওপর পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এছাড়া, সম্প্রতি যে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করা হয়েছে, তার কোনো নেতিবাচক প্রভাব আপাতত বাজারের ওপর পড়ার শঙ্কা না থাকলেও এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হচ্ছে। এ সব ঝুঁকি মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বৈষম্যহীন ও টেকসই ভিত্তি নিশ্চিত করা এখন আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।

২০২৬ সালের নভেম্বর মাসে স্বাভাবিক নিয়মে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা হতে আনুষ্ঠানিক উত্তরণ হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, উত্তরণ-পরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনাগুলো চিহ্নিত করে স্মোথ ট্রানজিশন পলিসি (এসটিএস) প্রণয়ন করা হয়েছে। বাণিজ্যিক খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে লজিস্টিকস খাতের উন্নয়নসহ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা  করা হচ্ছে এবং বাণিজ্য সম্ভাবনাময় বিভিন্ন দেশ ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোটের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়নের কাজ চলমান রয়েছে।

জিসিজি /এসআই