ঢাকা, বুধবার, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২২ মে ২০২৪, ১৩ জিলকদ ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

পোশাক শ্রমিকদের জীবন, বাবা-মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত শিশুরা

অতিথি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৫ ঘণ্টা, মে ১, ২০২৪
পোশাক শ্রমিকদের জীবন, বাবা-মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত শিশুরা

সাভার থেকে: জীবনের তাগিদে বিভিন্ন জেলার গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ স্ত্রী-সন্তানসহ শিল্পাঞ্চলে পাড়ি জমিয়েছেন। এদের মধ্যে প্রায় সবাই কাজ নিয়েছেন পোশাক কারখানায়।

অনেকেই চাকরিকালীন সময়ে জন্ম দিয়েছেন সন্তান। কিন্তু জীবিকার তাগিদে তাদের গ্রামে রেখে কিংবা বাসায় রেখেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাটাতে হয় কর্মস্থলে। তাই স্বাভাবিকভাবেই পিতৃ-মাতৃস্নেহ বঞ্চিত হয় সন্তানরা।  

পোশাক শ্রমিকদের জীবন সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিভিন্ন বিষয় বেরিয়ে এসেছে। পোশাক শ্রমিকরা অনেক সময় তাদের সন্তানকে বাসায় তালাবদ্ধ করে রেখে কর্মস্থলে যান। কেউবা সন্তানের নানি কিংবা দাদিকে বাসায় নিয়ে রাখেন শিশুদের পরিচর্যার জন্য। কিন্তু বাবা মায়ের দেখা মেলে না রাত ছাড়া। অনেক সময় সন্তানকে নানি কিংবা দাদীর কাছে রেখে আসতে হয় গ্রামে। এভাবেই চলছে বেশিরভাগ পোশাক শ্রমিকের জীবন।

শ্রমিকরা জানান, শিল্পাঞ্চলের বেশিরভাগ দম্পতিই পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কিন্তু সন্তানদের বাসায় একা রেখে কাজে যেতে হয় তাদের। কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টা নির্ধারিত হলেও ওভার টাইম করতে হয় শ্রমিকদের। কবে কত ঘণ্টা ওভার টাইম করতে হবে তা নির্দিষ্টভাবে জানেন না তারা। এছাড়া নারী পোশাক শ্রমিকরা গর্ভবতী হলে অনেকসময় চাকরি থেকে কৌশলে ছাঁটাই করা হয়। যদিও এ প্রবণতা বর্তমানে কমে গেছে।

পোশাক শ্রমিকের জীবন

স্বামী স্ত্রী পোশাক কারখানায় কাজ করেন। সকাল ৮ টার মধ্যে যেতে হবে কর্মস্থলে। তাই ভোর হতেই বিছানা থেকে উঠে রান্না শেষ করে দুপুরের খাবার বাটিতে ভরে কর্মস্থলের উদ্দেশ্য রওনা করতে হয়। কারখানা সংলগ্ন বাসা হলে দুপুরে এক ঘণ্টার মধ্যে বাসায় এসে খেয়ে আবার কর্মস্থলে পৌঁছাতে হয়। এরপর আবার শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। স্বাভাবিকভাবেই ৮ ঘণ্টা পর ছুটি হওয়ার কথা থাকলেও করতে হয় ওভার টাইম। বেশি টাকার আশায় ওভার টাইমের দায়িত্ব পালন করে তারা। রাত ৮ টা কিংবা ১০ টায় বাসায় ফিরে আবার রান্না করে রাতের খাবার খেয়ে ঘুম। সকালে উঠে আবার শুরু হয় কর্মব্যস্ততা।

পিতৃ-মাতৃস্নেহ বঞ্চিত সন্তানরা

পোশাক শ্রমিকদের সকাল ৮ টা থেকে রাত ৮ টা কিংবা ১০ টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। সন্তানেরা ঘুম থেকে ওঠার আগে সকালের কাজ শেষ করতে হয় তাদের। পরে  খাওয়ার সময় সন্তানকে ডেকে এক সঙ্গে খাবার খাওয়া পর্যন্ত দেখা হয় তাদের। খাওয়া শেষ করে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বের হন দম্পতিরা। এরপর দুপুরে ১ ঘণ্টার জন্য বাসায় এলেও তেমন সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। কারণ কারখানায় যাতায়াত কমপক্ষে ২০ মিনিট, খাবার খেতে ২০ মিনিট আর ২০ মিনিট রেস্ট করতেই সময় শেষ। সন্তানকে সময় দেওয়ার মতো সময় আর হয়ে ওঠে না। কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্তানরা অনেক সময় ঘুমিয়ে যায়। ফলে বাবা-মায়ের স্নেহ ছাড়াই বড় হতে থাকে শ্রমিকদের সন্তানরা।

সন্তান নিতে প্রতিবন্ধকতা

কোনো নারী শ্রমিক গর্ভবতী হলে তাকে মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতে হয় কর্তৃপক্ষের। ফলে সেই শ্রমিককে কৌশলে চাকুরিচ্যুত করতে পারলেই কারখানার লাভ। এমনটা ভেবে অনেকসময় গর্ভবতী শ্রমিকদের চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়ার জন্য বাধ্য করা হয়। গর্ভবতী হলে চাকরি যাওয়ার ঝুঁকি থাকে বলে অনেকেই সন্তান জন্ম দিতে ভয় করেন। তবে বর্তমানে শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে। গর্ভবতী নারীকে চাকুরিচ্যুত করা হলে ফৌজদারি অপরাধের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে গর্ভবতী নারীদের চাকুরিচ্যুত করার প্রবণতা কমে গেছে।

সন্তানের লেখাপড়া অনিশ্চিত

পোশাক শ্রমিকরা খোঁজ নিতে না পারায় সন্তানরা অনেক সময় হয় অশান্ত। তাদের লেখাপড়া হয়ে ওঠে অনিশ্চিত। ফলে পিতামাতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গৃহ শিক্ষক রেখে দেন। গৃহশিক্ষকরা যেভাবে পারেন সেভাবেই শিক্ষা দিয়ে চলে যান। লেখাপড়া বাদ দিয়ে সারা দিন খেলাধুলা করে কাটিয়ে দেয় শ্রমিকদের সন্তানরা। সারা দিন সময় না দিতে পারায় সন্তানকে একটু বেশিই ভালোবাসতে হয় তাদের। তাই লেখাপড়াতেও খুব একটা চাপ দিতে দেখা যায় না। এভাবে অনেক সন্তানের এসএসসি পর্যন্ত পড়াও সম্ভব হয় না। কিছুদিন পরে সন্তানকেও পোশাক কারখানা কাজ নিয়ে দিতে বাধ্য হয় পরিবার।

ছুটি স্বল্পতা

পোশাক শ্রমিকরা সকল সরকারি ছুটি উপভোগ করতে পারেন না। কিন্তু সেই ছুটির দিনগুলোতে কাজ করলে তাদের দেওয়া হয় বাড়তি টাকা। বাড়তি টাকা পেয়ে অনেকে খুশি হলেও ছুটিহীন থাকতে হয় তাদের।  

কাজের চাপ

পোশাক কারখানায় উৎপাদন প্রতি ঘণ্টায় হিসাব করে বুঝিয়ে দিতে হয় শ্রমিকদের। প্রতিদিন ঘণ্টায় টার্গেট দেন কর্মকর্তারা। টার্গেট পূরণ না হলেই শুনতে হয় কটুকথা। ফলে শ্রমিকরা টার্গেট পূরণে আপ্রাণ চেষ্টা করেন।

এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন বেশ কয়েক পরিবারের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। তার মধ্যে পোশাক শ্রমিক দম্পতি শাহিন ও তার স্ত্রী বীথি আক্তার বলেন, আমরা জীবিকার তাগিদে প্রায় ৮ বছর ধরে পোশাক কারখানায় কাজ করি। দীর্ঘ ৬ বছর আগে বিয়ে করেও সন্তান নেওয়ার সাহস হচ্ছে না। সন্তানকে কার কাছে রেখে কাজে যাবো এখন সন্তান হলে তার ভবিষ্যৎ তো অনিশ্চিত হবে। এছাড়া অনেককেই দেখেছি, ছোট ছোট সন্তান বাসায় একা রেখে কাজে যায়। তারা সারাদিন কোথায় থাকে, কোথায় যায় এর খোঁজ নেওয়ারও সময় হয় না বাবা মায়ের।

আবু তাহের দম্পতি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা গ্রাম থেকে এসেছি একটু ভালো থাকতে। সন্তানকে লেখাপড়া করাতে কষ্ট করছি। কিন্তু ছোট্ট সন্তানকে রেখে আসতে হয়েছে গ্রামে। দাদা-দাদির কাছে বড় হচ্ছে। বছরে দুই ঈদ ছাড়া সন্তানের মুখ দেখা হয়ে ওঠে না। বাবা-মায়ের স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত সন্তানেরা। টাকা রোজগার করার জন্য এত কষ্ট করছি। একা চাকরি করলে টাকা জমানো কষ্ট হয়ে যায়। দুই জন চাকরি করলে একজনের টাকা সঞ্চয় করা যায়। তাই কষ্ট হলেও দুই জনই চাকরি করছি।

বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সারোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, পোশাক শ্রমিকরা অনেক সময় সূর্যের আলোও দেখতে পান না। সন্তানকে দেখাশোনা কিংবা আদর যত্ন করাটা তাদের কাছে কল্পনা। শ্রমিক বাবা-মায়েরা টাকা রোজগার করতে গিয়ে সন্তানের খেয়াল রাখতে পারে না। চেষ্টা থাকলেও আসলে শ্রমিকদের সন্তানরা পিতৃ-মাতৃস্নেহ ছাড়াই বড় হয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৩ ঘণ্টা, মে ০১, ২০২৪
এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।