ঢাকা, বুধবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার মহাসমাবেশ, অনন্য নজির চট্টগ্রামে 

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০২১
সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার মহাসমাবেশ, অনন্য নজির চট্টগ্রামে  ছবি: উজ্জ্বল ধর

চট্টগ্রাম: সনাতনী সম্প্রদায়ের মঠ মন্দির ভাংচুর, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ ও ইসকন নোয়াখালী মন্দিরে সাধু-সন্ন্যাসী হত্যাসহ দেশজুড়ে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উত্তরণে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার সমাবেশ।  

বৃহস্পতিবার (২৮ অক্টোবর) নগরের নন্দনকানন চত্বরে এ মহাসমাবেশের আয়োজন করে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন), চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটি।

দুপুর ১২টা থেকে মহাসমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল থেকে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে দলে দলে সনাতনীরা সমাবেশস্থলে আসতে শুরু করেন প্লেকার্ড, ফেস্টুন, ব্যানার, জাতীয় পতাকা, গৈরিক পতাকা নিয়ে সমাবেশে যোগ দেন তারা। বিভিন্ন ফেস্টুনে লেখা ছিল, ‘তুমি কে, আমি কে, বাঙালি বাঙালি’, ‘তুমি যদি মানুষ হও, সাম্প্রদায়িকতা রুখে দাও’, ‘বাংলায় জন্মেছি, বাংলায় মরবো’, ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলমান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রীস্টান, আমরা সবাই বাঙালি’, ‘সাম্প্রদায়িকতা রুখো, বীর বাঙালি জাগো’, ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়তে হবে একসাথে’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’ ইত্যাদি।

 

দেখতে দেখতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে নন্দনকানন, ডিসি হিল প্রাঙ্গণ, বৌদ্ধবিহার সড়ক, তুলসীধাম সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক। মহাসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন  বাংলাদেশ ইসকনের সাধারণ সম্পাদক শ্রীপাদ চারুচন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে মুল অনুষ্ঠানমালা শুরু হয়। এরপর বৈদিক স্বস্তিবাচনের পরপরই স্বাগত বক্তব্য দেন ইসকন প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষ শ্রীপাদ লীলারাজ গৌর দাস ব্রহ্মচারী এবং দিকনির্দেশনামূলক ও দাবি সম্বলিত বক্তব্য দেন ইসকন চট্টগ্রামের বিভাগীয় সম্পাদক শ্রীপাদ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী।  

মহাসমাবেশে মহাআর্শিবাদক ছিলেন শংকর মঠ ও মিশনের আচার্য তপনানন্দ গিরি মহারাজ, তুলসীধামের মোহন্ত মহারাজ দেবদ্বীপ মিত্র পুরী মহারাজ, চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের উপাধ্যক্ষ ড. জিনবোধি ভিক্ষু, পাথরঘাটা ক্যাথলিক চার্চের ফাদার মিস্টার লেনার্ড।  

ইসকন সদস্য স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারী ও সাংবাদিক বিপ্লব পার্থের সঞ্চালনায় মহাসমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য দেন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ চট্টগ্রাম মহানগরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এমএ সালাম, নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজ উদ্দিন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নগর সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ইন্দু নন্দন দত্ত, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ পালিত, যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর, ইসকন কো রিজিওনাল সেক্রেটারি রাধা গোবিন্দ দাস ব্রহ্মচারী, বাংলাদেশ গীতা শিক্ষা কমিটির প্রধান উপদেষ্টা তপন কান্তি দাশ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী, পুলক খাস্তগীর, শৈবাল দাশ সুমন, নীলু নাগ, রুমকি সেনগুপ্তা, বাংলাদেশ জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক চন্দন তালুকদার, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুজিত কুমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী প্রবীর কুমার সেন, নগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি লায়ন আশীষ ভট্টাচার্য, ইসকন নন্দনকানন মন্দিরের অধ্যক্ষ পণ্ডিত গদাধর দাস ব্রহ্মচারী, ইসকন কুমিল্লা ও খাগড়াছড়ি মন্দিরের অধ্যক্ষ সুদর্শন জগন্নাথ দাস ব্রহ্মচারী, মিলন শর্মা, দেবাশীষ আচার্য, কাঞ্চন আচার্য, রুবেল কান্তি দে, সুমন চৌধুরী, অশোক চক্রবর্তী, অ্যাডভোকেট স্বরূপ পাল,  রাজীব দাশ বাবু, পিয়াল শর্মা, অজয় দত্ত, জুয়েল আইচ অর্ক প্রমুখ।  

বরেণ্য সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন বলেন, বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ৭২’র সংবিধান ফিরিয়ে আনতে হবে। সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। আর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করতে হবে। সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত, হামলাকারী ও উসকানিদাতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি নিশ্চিত করলে এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি রোধ হবে।  

এমএ সালাম বলেন, এ সম্প্রীতি সমাবেশ প্রমাণ করেছে বীর চট্টলায় সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান আমরা সবাই একই রক্তের মানুষ। আমাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। আর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বলতে কিছু নেই। আমরা সবাই বাঙালি। সংখ্যালঘু বলা সংবিধান পরিপন্থী। চট্টগ্রামসহ সারাদেশে যারা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলবো।

মোছলেম উদ্দিন আহমেদ বলেন, গত ১৩ বছর যারা পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছে তারাই সাম্প্রদায়িক হামলার সঙ্গে জড়িত। তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করে ক্ষমতায় যেতে চায়। কিন্তু এ দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। আমরা সাম্প্রদায়িকা প্রতিরোধে ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায় জনমত গড়ে তুলবো।  

আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, অসাম্প্রদায়িক দেশে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় আপনাদের মতো আমিও ব্যথিত। জননেত্রী শেখ হাসিনা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক। যেখানে সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেখানে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মানুষের দুঃখের কথা শুনেছেন এবং ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। চট্টগ্রামেও যেখানে ঘটনা ঘটেছে, আমি নিজে ছুটে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি। আপনাদের ক্ষোভ আমি বুঝি, আপনাদের দুঃখ কষ্ট আমি বুঝি। আমি আপনাদের সঙ্গে আগেও ছিলাম, এখনো আছি, ভবিষ্যতেও থাকবো।  

অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, রাজনৈতিক দলের নেতারা একটি কথা বলতে অভ্যস্ত। বাংলাদেশে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আছে তা পৃথিবীর কোনো জায়গায় নেই। আমি বলব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ ভাবে সংবিধানকে সাম্প্রদায়িকরণ করে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ খ্রিষ্টানে ভাগ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করেছে। আমরা সরকারি দলের মধ্যে একটা আত্মশুদ্ধি চাই। প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কোনো রাজনীতিবিদের ওপর আমাদের আস্থা নেই। আগামী দেড় দুই বছর আমরা ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘুদের নানাবিধ সংগঠন যুক্তভাবে আমরা মাঠে থাকব। নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে হবে। সময় আছে দেড় বছর। আমরা মাঠে আছি মাঠে থাকব। মাঠ ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাব না।

নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, বিএনপি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। হামলার ঘটনায় যারা প্রকৃত জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। নিরাপরাধ কাউকে যেন গ্রেফতার করা না হয় বা ঘটনা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলা না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। আসুন সবাই মিলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলি।  
 
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী বলেন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল সব ধর্মের সব জাতিসত্তার সমন্বয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধ সুখী বাংলাদেশ। এইজন্য তিনি সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি এটি আমাদের মাতৃভূমি হলেও একদিন হয়তো আমরা এদেশে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমাদের বিশ্বাস ও আস্থা এখনো অটুট। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমাদের আস্থা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। আমরা চাই, সকল সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার হোক, ক্ষতিগ্রস্ত মঠ-মন্দির রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পুনর্নির্মাণ হোক ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন মহান জাতীয় সংসদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হোক।  

সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় জড়িত ও উসকানিদাতাদের শাস্তি ফাঁসি করার দাবি জানান বক্তারা।  

সমাবেশ শেষে একটি শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব চত্বরে সমাপ্ত হয়। সমাবেশে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা হতে পাঁচ শতাধিক সংগঠন যোগদান করেন।  

বাংলাদেশ সময়: ১৯২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০২১ 
এআর/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।