ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

সব ভাষা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে: ড. শিরীণ আখতার

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১
সব ভাষা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে: ড. শিরীণ আখতার বক্তব্য দেন চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার

চট্টগ্রাম: আমাদের দেশে মিশ্র সংস্কৃতি এবং অনেক ভাষাভাষী লোক পাশাপাশি আছে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার বলেছেন, প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা আছে। বাংলাদেশের আপামর মানুষের মাতৃভাষা সংরক্ষিত হোক, চর্চা হোক এটাই আমরা চাই।

যদি একটি জনগোষ্ঠী নিজের মাতৃভাষা চর্চা করতে না পারে তাহলে তারা এগিয়ে যেতে পারবে না। বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হলে ক্ষুদ্র মন নিয়ে নয় সবাইকে নিয়ে আগাতে হবে।
 

শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) পিপল’স ভয়েস আয়োজিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদকপ্রাপ্ত মথুরা বিকাশ ত্রিপুরাকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।  

তিনি বলেন, পাহাড়ের জাতিগোষ্ঠীর ভাষাকে এগিয়ে নিতে অবশ্যই আমাদের কাজ করতে হবে। বাংলা ভাষাও অনেক সংগ্রাম করেছে। কোনো নৃগোষ্ঠী যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে আসে তাদের ভাষা মূলধারায় ঠাঁই করে নেয়। শুরুতে না হলেও গবেষণার মাধ্যমে প্রায়োগিক ভাষা সৃষ্টি হয়। এ চেতনা লালন করতে হবে যে আমরা সবাই এক। সবার সম্মান রক্ষার্থে অন্যদেরও একতাবদ্ধ থাকতে হবে।  

সংবর্ধিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদকপ্রাপ্ত মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, মাতৃভাষায় যখন কথা বলতে পারি না তখন মনে হয় যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। শৈশব থেকে মাতৃভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ পাইনি। শিক্ষার প্রয়োজনে অন্য একাধিক ভাষা শিখেছি। ভাষার আকুতি আমার নিশ্বাসের মতো। মাতৃভাষা প্রয়োগ করতে না পারলে ভেতরে ক্ষরণ তৈরি হয়।  

এদেশের মানুষ ভাষার জন্য আন্দোলন করেছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেই চেতনার সিঁড়ি বেয়ে স্বাধীন সার্বভৌম এই দেশ। আমরা গর্ববোধ করি ৫২’র ভাষা আন্দোলনের জন্য। সারাবিশ্বের মানুষ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে নিজ নিজ ভাষার গৌরব উদযাপন করে। এ স্বীকৃতি আমার জন্য গর্বের। শুধু আমার মাতৃভাষা নয় সবার মাতৃভাষা নিয়ে কাজ করার দায়িত্ব তৈরি হয়েছে। সরকার ভূমিকা রাখার ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে আমাদের কাজ করতে হবে।  

বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতিসত্তার ভাষার বিপন্নতার মাত্রা নিয়ে একটি গবেষণাকাজ শুরু করেছেন উল্লেখ করে মথুরা ত্রিপুরা বলেন, একটি ভাষা হারিয়ে গেলে সেই ভাষাকে কেন্দ্র করে যে জ্ঞান ব্যবস্থা তা হারিয়ে যাবে। তাই সব ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। একটি গহনার নকশার পুঁতির মতো সব ভাষা। কোনো ভাষা হারালে এদেশের বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য হারাবে।
 
কবি ও সাংবাদিক হাফিজ রশিদ খান বলেন, আদিবাসীদের কাছে প্রকৃত আলো পৌঁছায় না। চুক্তি হলে মনে করি একটা বোঝাপড়া হলো। আমরা খুব হাততালি দিই। প্রকৃত পরিস্থিতি তা নয়। আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়েও নানা বাধার মুখে পড়েছি। ইউরোপীয় ভাবধারায় কথামালা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তিগত সৌন্দর্য কখন আমাদের সামাজিক সৌন্দর্যে রূপ নেবে সে চেষ্টা করতে হবে। মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা এককভাবে লড়াই করে যাচ্ছেন। আজকের আয়োজন আমাদের অন্তরের অর্ঘ্য।  

সমাজ গবেষক শরীফ শমশির তার বক্তব্যে বলেন, প্রতি ভাষায় একজন করে বিদ্যাসাগর থাকেন, যিনি নিজ মাতৃভাষার বর্ণমালা ও ভাষার ভিত্তি গড়ে দেন। ত্রিপুরা ভাষায় অন্যতম বিদ্যাসাগর মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা। বাংলাভাষীদের অনেক ধন আছে অনেক দীনতাও আছে। আমরা বাংলা-ইংরেজি জানি। ত্রিপুরা ভাষা জানি না। সংবিধান প্রণয়নের সময় জাত্যাভিমানের কারণে অন্য জাতিসত্তাদের আমরা ধারণ করতে পারিনি। বিষয়টি বাঙালি পাহাড়ির দ্বন্দ্ব নয়। চলমান নিওলিবারেল বিশ্ব ব্যবস্থায় একটি দরিদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষাকে কত দূর নেওয়া যাবে? বাংলাও আজ চাপের মুখে। এ পরিস্থিতিতে মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা শুধু ত্রিপুরাদের নন। যাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে বিশ্ব পরিসরে তিনি তাদেরও প্রতিনিধি।  
লেখক ও সাংবাদিক নজরুল কবীর বলেন, ককবরক ভাষার নিজস্ব লিপি আছে। কিন্তু এ লিপিকে বড় লড়াই করতে হয় বাংলা ও রোমানের সঙ্গে। রোমান হরফে ককবরক ভাষা লেখা হতো, হয়। নিজের ভাষাতে ককবরক চর্চা অত্যন্ত প্রয়োজন। ভাষার লড়াই শুধু ভাষার সংগ্রাম না। মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা একটি প্রদীপ জ্বেলেছেন। আপনাদের শত প্রদীপ জ্বালাতে হবে। বাঙালির স্বাধীনতার লড়াইয়ে ত্রিপুরারা সম্পৃক্ত ছিলেন। অথচ আদিবাসী নারীদের মধ্যে কতজন মুক্তিযোদ্ধা আছেন সেটাও আমরা জানি না। ভাষা সংস্কৃতি টিকে না থাকলে শুধু চেহারার ভিন্নতাই থাকবে। সত্যিকারের জাতি পরিচয় টিকবে না। লড়াইটা আদিবাসী বন্ধুর সঙ্গে বাঙালিরও।  

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিএম দিনময় রোয়াজা বলেন, মথুরা বিকাশ ত্রিপুরার অর্জনে আমরা গর্বিত। একসময় বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছিল ত্রিপুরা রাজ্য। কুমিল্লা জেলার আগের নাম ছিল ত্রিপুরা। কুমিল্লা ছিল ত্রিপুরার দ্বিতীয় রাজধানী। চট্টগ্রাম নোয়াখালী কুমিল্লা রামু পর্যন্ত ছিল ত্রিপুরা। এখন ভারতে একটি রাজ্য ত্রিপুরা। সেখানকার বাসিন্দারা ত্রিপুরা ভাষায় কথা বলেন। এখন সরকার চাইছে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় চর্চা হোক।  

চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের গ্রন্থাগার সম্পাদক মিন্টু চৌধুরী বলেন, সমতলের মানুষ যতটা এগিয়ে থাকে সে সুযোগ আদিবাসী জনগোষ্ঠী পায় না। প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠী নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকার বিশ্ব স্বীকৃত। আমাদের দেশে নানা জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়ার পথে। যেসব জনজাতির সংখ্যা কম তাদের ভাষা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া খুব জরুরি। ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি রাষ্ট্রের সহযোগিতা প্রয়োজন।  

পিপল’স ভয়েস সভাপতি শরীফ চৌহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন পিপল’স ভয়েসের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আতিকুর রহমান এবং সংবর্ধিত অতিথির জীবনীপাঠ করেন কাজী মুশফিকুস সালেহীন।

বাংলাদেশ সরকার কর্তৃত প্রবর্তিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদকে ২০২১ ভূষিত হয়েছেন জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম ও মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণ, শিক্ষা, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, আর্থ-সামাজিক বিষয়, সংস্কৃতি ও মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রচলনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা।  

অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত অতিথিকে ফুল দিয়ে সম্মান জানায় চট্টগ্রাম মহানগর ত্রিপুরা কল্যাণ ফোরাম এবং ত্রিপুরা স্টুডেন্ডস ফোরাম বাংলাদেশ মেট্রোপলিটন শাখা। সংবর্ধিত মথুরা বিকাশ ত্রিপুরাকে সম্মাননা স্মারক ও তৈলচিত্র তুলে দেন পিপল’স ভয়েসের সদস্যরা।  

বাংলাদেশ সময়: ২০১৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১
এআর/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।