ঢাকা, মঙ্গলবার, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২১ মে ২০২৪, ১২ জিলকদ ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

পথচলার আটাশ বছর পূর্ণ করছে বোধন

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০১৫
পথচলার আটাশ বছর পূর্ণ করছে বোধন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: ‘আঁধার ভেঙ্গে আলোর বুনন’ স্লোগানে আগামীকাল শুক্রবার পথচলার আটশ বছর পূর্ণ করছে বোধন আবৃত্তি পরিষদ।   ১৯৮৭ সালের ৯ জানুয়ারি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন রাজপথে লড়াকু কয়েকজন আবৃত্তিকর্মীর উদ্যোগে জন্ম হয়েছিল বোধনের।

আটাশ বছরের দীর্ঘ এই পথচলায় বোধন আবৃত্তি চর্চায় এনেছে বৈচিত্র্য, পরিবর্তন এনেছে আবৃত্তির গুণগত মানে এবং সাংগঠনিক চর্চায় যুক্ত করেছে নতুন নতুন মাত্রা।   শুধু কর্মসূচির দিক থেকে নয় সদস্যসংখ্যার দিক থেকেও সংগঠনটির বিস্তার ঈর্ষনীয়।


স্কুল:
আৃবত্তিতে বোধনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান ‘বোধন আবৃত্তি স্কুল’। আবৃত্তি শেখানো ও চর্চার উৎকর্ষের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে বোধন প্রতিষ্ঠা করে দেশের প্রথম ও একমাত্র আবৃত্তি বিষয়ক স্কুল। সে বছর ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনয় ও আবৃত্তিশিল্পী, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতি বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বোধন আবৃত্তি স্কুলের উদ্বোধন করেন।   বর্তমানে বোধন স্কুলের ৪১তম আবর্তন চলছে।   এ যাবত প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষার্থী বোধনে প্রশিক্ষণ  গ্রহণ করেছেন।   ছয় মাসব্যাপী বোধন স্কুলের কোর্সে আবৃত্তি অনুষঙ্গ হিসেবে রয়েছে শুদ্ধ উচ্চারণ, কবিতার ভাব ও রস, ছন্দ, উপস্থাপনা, সংবাদ পাঠের মতো বাচিকশিল্প সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ।

প্রযোজনা ও অনুষ্ঠান:
বোধন প্রতিষ্ঠার পর থেকে অসংখ্য প্রযোজনা মঞ্চে নিয়ে আসে। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রযোজনা এখনো দর্শকদের বিপুল সাড়া পাচ্ছে।   উল্লেখযোগ্য প্রযোজনার মধ্যে রয়েছে ‘কাজল রেখা’, আমিনা সুন্দরী, রাজসভায় মাধবী, কিষানকাব্য, এখনো একাত্তর, মৃত্যুলোকে সশরীরে, যাদুকেন্দ্রিক, আলেয়া, ইতিহাসের কথা, জয় সত্যের জয়, সেই সব স্বপ্ন, দেবতার গ্রাস, ডাকঘর, কাবুলী ওয়ালা, স্বপ্নবান অস্ত্র চাই, মুজিব মানে মুক্তি, বিষ বিরিক্ষের বীজ, হিং টিং ছট।

শিশুবিভাগ প্রযোজনার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হিংসুটে, হাসির সুতোয় বোনা, গুরুশিষ্য, পান্তা বুড়ির গল্প, আজকে ছুটির দিন, ছড়ানো ছিটানো ছড়া, ভূতের জাদু, বাংলাদেশের কথা,

বোধনের দীর্ঘ পথচলায় বেশ কিছু নিয়মিত ও ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের আয়োজন লক্ষ্য করা যায়, দর্শক নন্দিত অনুষ্ঠানগুলো হচ্ছে, জাগাও প্রাণের সুপ্ত শক্তি, লেখাপড়া, কবিতায় কথা কই, আবৃত্তি আড্ডা, কবি ও কবিতা, নিজেরে কর জয়, সকালবেলার পাখি, জাগো সুন্দর, নবীনবরণ, সমাবর্তন, একুশ মানে মাথা নত না করা।

সম্মাননা:
বোধন খ্যাতিমান অনেক আবৃত্তিশিল্পীকে সম্মাননা প্রদান করেছে।   এদের মধ্যে রয়েছেন প্রয়াত অভিনেতা ও আবৃত্তিশিল্পী গোলাম মুস্তাফা।   গোলাম মুস্তাফা একবারই চট্টগ্রাম আসেন এবং আবৃত্তি শুনিয়ে দর্শক ও শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন ১৯৯৫ সালে। বোধনের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তিনি মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুল মাঠে হাজার হাজার দর্শকদের সামনে আবৃত্তি পরিবেশন করেন। বোধন এই শিল্পীকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। বোধন সম্মাননা জানায় দেশের প্রখ্যাত আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এছাড়াও  ভারতের শিল্পী পার্থ ঘোষ,  গৌরী ঘোষ, প্রদীপ ঘোষ ও প্রয়াত শিল্পী সাকোয়াত খান এবং গত ২৭ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে সম্মাননা প্রদান করা হয় এ সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় আবৃত্তিশিল্পী ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

সেরা সংগঠন হিসেবে বোধন বেশ কিছু সংগঠনের পক্ষ থেকে সম্মাননা গ্রহণ করেছে। যে সমস্ত সংগঠন বোধনকে সম্মাননা প্রদান করেছে তার মধ্যে অন্যতম হল কথা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র, স্বরকল্পন ঢাকা, স্বনন ঢাকা, কলকাতা থেকে পাওয়া মঞ্জুস দাশগুপ্ত স্মৃতি পদক।

উৎসব কথা :
বোধনের আয়োজনে প্রথম উৎসবটি ছিল ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে; শিশু উৎসব।   উৎসবে ছিল শোভাযাত্রা, আবৃত্তি, গল্পবলা, আবৃত্তি প্রতিযোগিতা ও শিশুদের জন্যে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী।   ২০০২ সালে ‘মুহূর্ত তুলিয় শির একত্র দাঁড়াও সবে’ স্লোগান নিয়ে পনের বছর পূর্তি উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োাজন বোধন আয়োজন করে তিন দিনব্যাপী আবৃত্তি উৎসব।   ঢাকা থেকে আমাদের আবৃত্তির প্রায় সব পরিচিত শিল্পীদের এক মিলনমেলা ছিল পনের বছর পূর্তি উৎসবের তিনটি দিন।   অতিথি ছিলেন রবীন্দ্রসংগীত গবেষক ওয়াহিদুল হক, কবি সৈয়দ শামসুল হক, আবৃত্তিশিল্পী আসাদুজ্জামান নূর, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি আবুল মোমেন, হাসান আরিফ, গোলাম সারোয়ার, মাহিদুল ইসলাম। কলকাতা থেকে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন শিল্পী অরুণাভ গাঙুলী ও মলি দেবনাথ।

‘জাগিয়ে দেরে চমক মেরে আছে যারা অর্ধ্বচেতন’ শিরোনামে বোধন আয়োজন করে আঠার বছর পূর্তি উৎসব; ২০০৫ সালে। ভারত থেকে অতিথি হিসেবে আসলেন বরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী প্রদীপ ঘোষ। আবৃত্তির দল আসল ঢাকা, রাজশাহী, ফেনী থেকে। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী প্রয়াত ড. জামাল নজরুল ইসলাম, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, শিমুল মুস্তাফা, হাসান আরিফ, লায়লা আফরোজ, মাহিদুল ইসলাম, রফিকুল ইসলামসহ আরো অনেকে।

২০০৯ সালের অক্টোবর; বোধন স্কুলের ষোল বছর। ‘উচ্চারো আজ উচ্চারিত শাণিত উচ্চারণ’ স্লোগান নিয়ে আয়োজন করা হয় উৎসব। উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী আর উদ্বোধন করেছিলেন আবৃত্তিশিল্পী আসাদুজ্জামান নূর।

রবীন্দ্র উৎসব :
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে বোধন ২০১১ সালের জুনে আয়োজন করে দুই দিন ব্যাপী উৎসব। কলকাতা থেকে রত্না মিত্রের নেতৃত্বে একটি গান-আবৃত্তির দল এতে অংশ নেয়। ঢাকা থেকে অংশ নেন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মহিউজ্জামান চৌধুরী ময়না, লিলি ইসলাম, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়সহ অনেকে।  

রজতজয়ন্তী:
২০১২ সালটি ছিল বোধনের রজতজয়ন্তীর বছর।   বছর জুড়ে ছিল বোধনের বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান। সমাপনী অনুষ্ঠানটি ছিল চারদিন ব্যাপী; ২৫, ২৬, ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর ২০১২।   চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহকে উৎসর্গ করা উৎসব উদ্বোধন করেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। এতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আবৃত্তিশিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, গোলাম সারোয়ার, মাহিদুল ইসলামসহ অনেকে। ভারতের কলকাতা থেকে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন খ্যাতিমান আবৃত্তিশিল্পী ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়। চারদিনের  উৎসবের শেষ দিনে উপস্থিত ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।

উৎসব উদ্বোধন পর্বটি বরাবরই বোধন তার নিজস্ব ঢঙে করে থাকে। প্রদীপ প্রজ্বালনের মধ্য দিয়ে শত কণ্ঠে আবৃত্তি। এবারও ব্যতিক্রম ছিল না। বরং এবার শিল্পীর সংখ্যা ছিল ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় দুই শত। আর বোধনের পঁচিশ বছরে বোধনের শিল্পীদের কণ্ঠেও ছিল সুকান্তের ‘বোধন’ কবিতাটির নির্বাচিত পঙক্তিমালা।

বসন্ত উৎসব:
বোধন প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামের ডিসি হিলে আয়োজন করে বসন্ত উৎসব।   সেই উৎসবেরও আজ ৯টি বছর হতে চলল।   প্রতিবছর পহেলা বৈশাখের উৎসবের মতো বসন্ত উৎসবও হয়েছে চট্টগ্রামের সর্বজনীন উৎসবগুলোর অন্যতম।

পত্রিকা:
সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালেবোধন প্রকাশ করে বাংলাদেশের প্রথম আবৃত্তিবিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘আবৃত্তি’। বর্তমানে এর প্রকাশনা বন্ধ থাকলেও এক সময় এই পত্রিকার কাটতি ছিল চট্টগ্রাম শহর ছাড়িয়ে রাজধানী ঢাকাসহ কোলকাতায়।

অ্যালবাম:
বোধনের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য পারভেজ চৌধুরী ও প্রশান্ত চক্রবর্তীর একক আবৃত্তির এ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা থেকে। বইমেলা ২০১৫ উপলক্ষে সায়রা শাহীদ ও জাভেদ হোসেনের কণ্ঠে একটি অ্যালবাম প্রকাশের কাজ সমাপ্তির পথে।

এই ব্যাপক কর্মযজ্ঞ বোধন আবৃত্তি পরিষদকে দেশের অন্যতম একটি সংগঠনে পরিণত করেছে। বোধনের সাধারণ সম্পাদক সোহেল আনোয়ার জানান, সংগঠনের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে স্কুল পর্যায়ে কর্মশালা পরিচালনা, উপজেলা পর্যায়ে উৎসবের আয়োজন করা, আবৃত্তি পত্রিকার পুনর্প্রকাশ, আড়ম্বরতার সঙ্গে ২০১৭ সালে তিন দশক পূর্তি উৎসবের আয়োজন করা।

বাংলাদেশ সময়: ১২২২ ঘন্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।