ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

খুনের আগ পর্যন্ত ওসমানের হেফাজতে ছিল জামাল উদ্দিন

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০১৪
খুনের আগ পর্যন্ত ওসমানের হেফাজতে ছিল জামাল উদ্দিন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনকে অপহণের পর ফটিকছড়িতে নিয়ে গেলে কাঞ্চননগরের চারা বটতল এলাকায় সুলতান ড্রাইভারসহ চারজন তাকে গ্রহণ করে। সেখান থেকে তাকে গহীন পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

জামাল উদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করা পর্যন্ত সুলতান ড্রাইভার, কালা মাহাবুব, লম্বা মাহাবুব ও টেংরা ওসমান তার দেখাশোনা করেন।

গ্রেপ্তারের পর নগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য দিয়েছেন সুলতান ড্রাইভার।
প্রায় ৯ বছর পালিয়ে থাকার পর সুলতান রোববার (২ মার্চ) কক্সবাজার শহর থেকে গ্রেপ্তার হন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জামাল উদ্দিন অপহরণের ‍অন্যতম হোতা ফটিকছড়ির কাশেম চেয়ারম্যান ছিলেন সুলতানদের গডফাদার। কাশেমের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন বলি মনসুর ও ওসমান। সুলতান, কালা মাহবুব, লম্বা মাহবুবসহ অন্যরা ছিলেন সরাসরি বলি মনসুর ও ওসমানের নিয়ন্ত্রণে।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার বাবুল আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, ‘জামালউদ্দিনকে ফটিকছড়িতে রাখা এবং গুলি করে হত্যা করা পর্যন্ত সব দায়িত্বই পালন করেছে ওসমানসহ কয়েকজন। তারা কাশেম চেয়ারম্যানের নির্দেশে এ দায়িত্ব পালন করেছে বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে। ’

জামাল উদ্দিন অপহরণের মামলাটি এখন সিআইডি তদন্ত করছে। তারা সুলতানকে রিমাণ্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে বলে মত দিয়েছেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকতারা।

এডিসি বাবুল আক্তার জানান, ২০০৫ সাল থেকে সুলতান ড্রাইভার গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য কক্সবাজারে অবস্থান করছিল। এর মধ্যে সুলতান নিজের নাম, ঠিকানাও পরিবর্তন করে।

নাম পাল্টে নূরুল ইসলাম, পিতা-মো. রিয়াজ, মা-হালিমা খাতুন, সাং-দক্ষিণ মাদার্সা বৈদ্যের বাড়ী, থানা-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম, এ ঠিকানায় জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করে।
ctg_DB_Arrest
২০০৫ সালে সুলতান পালিয়ে কক্সবাজার গিয়ে প্রথমে রিক্সা চালানো শুরু করে। কয়েক বছর পর সে কাঁচা তরকারির ব্যবসা শুরু করে। এরপর গত প্রায় তিন বছর ধরে হ্যান্ডি রেষ্টুরেন্টে সাত হাজার টাকা বেতনে চাকরি করছে। তার স্ত্রী ও সন্তান ফটিকছড়িতে থাকলেও এলাকার লোকজন জানতো সে বিদেশে অবস্থান করছে।

গ্রেপ্তারের পর সুলতান নিজেকে নূরুল ইসলাম পরিচয় দিলে গোয়েন্দা পুলিশ কিছুটা বিপত্তিতে পরে। পরবর্তীতে ফটিকছড়ি থেকে লোক এনে তার পরিচয় নিশ্চিত হয় নগর গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা।

গ্রেপ্তারের পর রোববার গভীর রাতে সুলতান ড্রাইভারকে নগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। সোমবার সকালে তাকে একটি অস্ত্র মামলার পরোয়ানাভুক্ত আসামী হিসেবে ফটিকছড়ি থানায় হস্তান্তর করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।

উল্লেখ্য ২০০৩ সালের ১৩ জুলাই নগরীর চকবাজারের ব্যবসায়িক কার্যালয় থেকে চান্দগাঁওয়ের বাসায় ফেরার পথে অপহৃত হন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন চৌধুরী। এরপর অপহরণকারীরা এক কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।

অপহরণের পর প্রায় ২ বছর ধরে কোন খোঁজ মিলেনি এ নেতার। শেষ পর্যন্ত ২০০৫ সালের ২৪ আগস্ট ফটিকছড়ির দুর্গম পাহাড় থেকে উদ্ধার করা হয় জামাল উদ্দিনের কঙ্কাল।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সেই জায়গাটি দেখিয়েছিল এ মামলার অন্যতম আসামী ও ফটিকছড়ির শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা মাহবুব। পরে মাহাবুবের জবানবন্দিতে এসে পড়ে বিএনপি নেতা সরওয়ার জামাল নিজাম ও মারুফ নিজামের নাম। ২০০৯ সালে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে কারাগারে মারা যান কালা মাহাবুব।

আদালত সূত্র জানায়, ঘটনার তিন বছর পর ২০০৬ সালের ২০ জুন আদালতে এ মামলার প্রথম চার্জশিট দাখিল করেন সিআইডি চট্টগ্রাম জোনের তৎকালীন পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন। কিন্তু এ চার্জশিটে বাদ পড়েন ঘটনার মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য সরওয়ার জামাল নিজাম এবং তার ভাই মারুফ নিজাম। মূলহোতাদের বাদ দেয়ায় আদালতে নারাজি আবেদন করেন জামাল উদ্দিনের স্ত্রী নাজমা আক্তার খানম।

এরপর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডি চট্টগ্রাম জোনের তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার হামিদুল হক। দায়িত্ব পাওয়ার ২০ দিনের মাথায় ২০০৬ সালের ১০ জুলাই আদালতে পুনরায় চার্জশিট দাখিল করেন তিনি। এতে অভিযুক্ত হয় ১৬ জন আসামি। তবে যথারীতি এ চার্জশিটেও বাদ দেয়া হয় ঘটনার মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্তদের। এ চার্জশীটের বিরুদ্ধেও আদালতে নারাজি আবেদন জানান বাদি।

আদালতে দাখিল করা ওই চার্জশিটে যে ১৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তারা হল, শহীদ চেয়ারম্যান, কালা মাহবুব, শফিকুল আলম, সোবহান ড্রাইভার, সুলতান, শওকত, মনসুর, কাশেম চেয়ারম্যান, ইসহাক, নাজিম, ইউনুচ, লম্বা মাহবুব, আলমগীর, ওসমান, রফিক ও শাহজাহান।

এ মামলায় অভিযুক্ত প্রায় সব আসামি ধরা পড়লেও ধরাছোঁয়োর বাইরে থেকে গেছে ঘটনার অন্যতম হোতা ফটিকছড়ির কাশেম চেয়ারম্যান। বর্তমানে শহীদ চেয়ারম্যান ছাড়া বাকি সব আসামি জামিনে আছেন। আবার কেউ কেউ জামিন নিয়ে পলাতক রয়েছে বলেও আদালত সূত্র জানিয়েছে।

এদিকে জামাল উদ্দিনকে অপহরণের কারণও এখনও উদঘাটন হয়নি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, জামাল উদ্দিন ছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী হতে আনোয়ারা থেকে তিনি তিনবার মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন। প্রতিবারই নির্বাচন করেন সরওয়ার জামাল নিজাম। এরপরও তিনি ছিলেন দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী। প্রতিদ্বন্দ্বীকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার জন্যই এ অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড ঘটানো  হয় বলে অভিযোগ জামাল উদ্দিন পরিবারের।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২০ঘণ্টা, মার্চ ০৩,২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।